ভ্যান চাওয়া তেল বিক্রেতা সেই বৃদ্ধা এখন শয্যাশায়ী

ভ্যান চাওয়া তেল বিক্রেতা সেই  বৃদ্ধা এখন শয্যাশায়ী

নাম জছিমন বিবি। সবাই তাকে তেলওয়ালী বলেই চিনেন। বয়স ৯০ পেরিয়েছে। এতো বয়সে কথা ছিল ছেলের রোজগারে সুয়ে-বসে খাওয়ার। কিন্তু ভাগ্য পরিহাস করেছে তাঁর সাথে। আজ থেকে প্রায় আড়াই মাস আগেও জছিমন বিবি ঘানিতে ভাঙা সরিষা তেল নিয়ে সাইকেলের প্যাডেল মেড়ে ছুটতেন একগ্রাম থেকে আরেক গ্রামে। তিনি স্বামীর কাছে শিখেছিলেন ঘানিতে তেল ভাঙা। স্বামী যুদ্ধচলাকালে মারা গেলেও সেই কাজ আঁকড়ে ধরে যুদ্ধের ৫০ বছর পরও এক শারীরিক অক্ষম ছেলেসহ পূত্রবধূ এবং নাতীদের ভরণ-পোষণ করতেন জছিমন বিবি। এতো বয়সে আর সাইকেল চলাতে পারতেন না তিনি। তাই চেয়ারম্যান-মেম্বারদের কাছে একটা ভ্যান দাবি করেছিলেন। কিন্তু কেউ শোনে’নি তাঁর কথা। এখন জছিমন বিবি শয্যাশায়ী।

          জছিমন বিবি দিনাজপুরের ফুলবাড়ী উপজেলার ৩নং কাজিহাল ইউনিয়নের রসুলপুর পশ্চিমপাড়া গ্রামের মৃত আশরাফ আলীর স্ত্রী।

          গত ২০২০ সালে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকের ফুলবাড়ীর কিছু গ্রæপে আলোড়ন সৃষ্টি করে জছিমন বিবির সাইকেল চালিয়ে ঘানিতে ভাঙা সরিষার তেল বিক্রি করার তথ্যটি।

          জানায় যায় জছিমন বিবি এতো বয়সেও ঘানীতে সরিষার তেল ভেঙে একটি ভাঙা সাইকেল নিয়ে ফুলবাড়ী উপজেলার রুদ্রানী, আটপুকুরহাট, মিরপুর, জলেশ^রী, ভেড়ম, বশিদপুর, জঙ্গলপাড়াসহ আশপাশের এলাকায় হেঁটে হেঁটে সেই তেল বিক্রি করতেন। রোজ সেই তেল বিক্রি করে আবারো তেল ভাঙার জন্য ফুলবাড়ী বাজার থেকে সরিষা কিনে বাড়ি ফিরতেন। বয়সের কারণে সাইকেল ঠিকঠাকভাবে চালাতে না পারায় সবার কাছে বলতেন, ‘আমাকে একটা ভ্যান দেন। সেই ভ্যানে বসে আমি তেল বিক্রি করতে যাবো।’ কিন্তু গত আড়াই মাস আগে বাড়ি থেকে তেল নিয়ে বের হয়ে স্থানীয় একটি বাজারে হঠাৎ করে অসুস্থ হয়ে পড়েন জছিমন বিবি। পরে তাকে সেখান থেকে উদ্ধার করে স্থানীয়রা বাড়িতে নিয়ে আসলেও মিলেনি তার সেই ভাঙা সাইকেলটি।

          গতকাল সোমবার জছিমন বিবির বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, গরু টানা সেই ঘানিটি থেমে আছে। তার পাশেই খোলা আকাশের নিয়ে সুয়ে আছেন জছিমন বিবি। খাওয়া-দাওয়া ছেড়ে শুধুই ঝড়ছে অশ্রæজল। ছেলের হাত ধরে বলছেন ‘আমাকে ভ্যানে তুলে দে। আমি ভ্যানে সুয়েই তেল বিক্রি করতে যাবো। ঘরে খাবার নাই। আমি তেল বিক্রি করে বাজার করে নিয়ে আসবো।

          ছবিমন বিবির পুত্রবধূ আরজিনা বেগম বলেন, ‘আমার শাশুড়ি দীর্ঘ ৫০ বছর ধরে এই পরিবারের ভরণ-পোষণ করছেন। এতো বয়সেও তার রোজগারে আমাদের মুখে আহার জুটতো। আমার স্বামীও শারীরিক অক্ষম তাই তিনিও কাজ করতে পারেন না। গত আড়াই মাস আগে আমার শাশুড়ির ডান পা প্যারালাইসিস হয়েছে। তিনি বাড়িতে পড়ে আছেন। পরিবারে রোজগার করার মতো কেউ না থাকায় আমার দুই ছেলেকে পড়ালেখা বাদ দিয়ে ছোট ছেলেকে ঢাকায় এবং বড় ছেলেকে স্থানীয়ভাবে কাজে লাগিয়েছি। বহুদিন থেকে আমার শাশুড়ি চেয়ারম্যান-মেম্বারদের কাছে একটা ভ্যান চেয়েছিল। কিন্তু তারা আমাকের দিকে দেখেন না। শাশুড়ি বিছানায় পড়ে যাওয়ার পর থেকে দুইবেলা খারার জুটছে না। সরকার এতো খাবার ও টাকা দিলেও সেইগুলো আমাদের নাম দেয় না চেয়ারম্যান মেম্বাররা। তারা শুধু ভোটের সময় মিষ্টি মিষ্টি কথা বলেন। কবিরাজ বলেছে আমার শাশুড়ির সেই পা ঠিক করা যাবে কিন্তু তার জন্য প্রয়োজন আট থেকে ১০ হাজার টাকা। কিন্তু এতো টাকা কোথায় পাবো? মানুষের কাছে চাইতেও পারছি না।’

জছিমন বিবির প্রতিবেশি নাছিমা বেগম ও তোফাজ্জল হোসেন বলেন, ‘আমরা ছোট থেকে দেখছি জছিমন বিবি ঘানিতে তেল ভেঙে নিজেই বিক্রি করে সংসার চালান। কিন্তু গত একবছর ধরে চেয়ারম্যান -মেম্বারদের কাছে একটি ভ্যান দাবি করেও কোনো লাভ হয়নি। কেউ শোনে’নি জছিমন বিবির আর্তনাদ। গত আড়াই মাস থেকে জছিমন বিবি বিছানায় পড়ে যাওয়ায় খেয়ে না খেয়ে দিন কাটছে তার পরিবারের। চেয়ারম্যান মেম্বারদের দেখা মিলে শুধু ভোটের আগে। ভোট শেষে আর দেখা মিলে না।’

          কাজিহাল ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মো. মানিক রতন বলেন, ‘আমার কাছে ভ্যান দাবি করেন’নি। তবে তিনি একটি বাড়ি দাবি করেছেন। এখন তো সরকার শুধু ভূমিহীন ও গৃহহীনদের ঘর দিচ্ছেন। যাদের ঘর আছে বাড়ি নেই সেই বরাদ্দ আসলে তাকে একটি ঘর দেয়া হবে।

আরও পড়ুন

×