প্রকাশিত: 17/09/2019
প্রসঙ্গ : কাস্টমস কমিশনার বেলাল চৌধুরী
সৎ কর্মকর্তাদের রক্ষায় রাষ্ট্র এগিয়ে না
এলে ক্ষতিগ্রস্ত হবে আগামী প্রজন্ম
রফিকুল আনোয়ার : গত ৮ আগস্ট শতাব্দীর সেরা বিস্ময় এশিয়ার বৃহত্তম ভায়াগ্রা চালান গডফাদারদের রক্তচক্ষু এবং কোটি টাকার অফারকে পরিহার করে ২৫০০ কেজি ভায়াগ্রা যার দাম ১২ কোটি টাকা তা আটক করে দেশ এবং আন্তর্জাতিকভাবে আলোচনায় আসেন বেনাপোল কাস্টমস কমিশনার বেলাল চৌধুরী। বাংলাদেশের যেসব সরকারি কর্মকর্তা সৎ তাদের মধ্যে একজন বেলাল চৌধুরী। এই সততার পুরষ্কার হিসেবে ওয়াল্ড ব্যাংক কর্তৃক সেরা কমিশনারের পুরষ্কারসহ পেয়েছেন বিজনেস এক্সিলেন্স এ্যাওয়ার্ড-২০১৯। ৮ আগস্ট অর্থাৎ ভায়াগ্রার বিশাল চালান আটকের পূর্বে বেলাল চৌধুরীর বিরুদ্ধে কারো কোন অভিযোগ ছিল না। ভায়াগ্রা আটকের পরপরই অভিযোগ ওঠে তার বাড়ি, গাড়ি, সহায়-সম্পত্তি, ছেলে-মেয়ের লেখাপড়াসহ শালা-শালীর খবর পর্যন্ত। আর এসব খবর একশ্রেণীর সংবাদপত্র মনের মাধুরী মিলিয়ে প্রচারও করতে থাকে। বেলাল চৌধুরীর বিরুদ্ধে উত্থাপিত ১৫টি অভিযোগের কোনটিরই সত্যতা পাওয়া পায়নি এনবিআর। দুদকের চারটি স্থানে বিভিন্ন নামে বেলাল চৌধুরীর বিরুদ্ধে অভিযোগ করা হয়। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড বেলাল চৌধুরীর বিরুদ্ধে উত্থাপিত ১টি অভিযোগেরও সত্যতা না পাওয়ায় তারা বিব্রত ও অসন্তুষ্ট। বেলাল চৌধুরীর বিরুদ্ধে উত্থাপিত কোন অভিযোগই এ যাবতকাল পর্যন্ত সত্য বলে প্রমাণিত হয়নি। এখন প্রশ্ন উঠেছে কেনই বা বেলাল চৌধুরীর বিরুদ্ধে মহল বিশেষের এই অপপ্রচার। বেলাল চৌধুরী একক কোন ব্যক্তি নয়, একটি টিমের নায়ক। এই দলনেতাকে ব্যস্ত রেখে সুকৌশলে ভায়াগ্রা গডফাদার এবং তাদের সমর্থকরা অন্যকোন সুবিধা নিচ্ছে নাতো?
সরজমিন অনুসন্ধানে দেখা গেছে, বেলাল চৌধুরী বেনাপোল কাস্টমস এ যোগদানের পূর্বে আমদানি পণ্য ছাড় করাতে এ স্থল বন্দরে সময় লাগতো ১০ থেকে ১৫ দিন। এখন সময় লাগে মাত্র ১ দিন। পণ্য খালাসে সময় কমে যাওয়াতে আমদানি-রফতানির গতিশীলতা বৃদ্ধিসহ রাষ্ট্রের অনেক লাভ হলেও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে একটি মহল। খতিয়ে দেখা সময় এসেছে কাস্টমসে ঘাপটি মেরে থাকা অশুভ শক্তি, যারা ১ দিনে পণ্য খালাসে অখুশী। বেলাল চৌধুরীর বিরুদ্ধে অপপ্রচারে তাদের ইন্ধন রয়েছে কিনা? বেনাপোল কাস্টমস্ সূত্রে জানা গেছে, বেলাল চৌধুরী যোগদানের পর বেনাপোল কাস্টম হাউসের নিরাপত্তা জোরদারে স্ক্যানিং মেশিনের পাশাপাশি অত্যাধুনিক মেটাল ডিটেকটর ও সিসি ক্যামেরা স্থাপন করা হয়েছে। ট্র্যাভেল ট্যাক্স সহজীকরণের জন্য সোনালি ব্যাংক বুথ বৃদ্ধি করা হয়েছে। যাত্রী হয়রানি বন্ধে চেকপোস্টে বহিরাগত প্রবেশরোধে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। নিবিড় তদারকির জন্য একজন ডেপুটি কমিশনারকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। সংস্কারের মাধ্যমে আমদানি পণ্যের সুষ্ঠ ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করতে উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ৩৬ ধরণের রপ্তানি পণ্য দ্রুত প্রেরণে দুটি লিংক রোড চালু করা হয়েছে। কার্গো সংস্কারের আগে ভারত একটি পথ বন্ধ রাখতো। লিংক রোড চালু করায় পণ্যজট ও আমদানি-রপ্তানি ব্যয় কমেছে অনেকখানি। কার্গো শাখার আরেকটি সাফল্য বেনাপাস সফটওয়্যার চালু। এর মাধ্যমে ভারতীয় আমদানি পণ্যবাহী গাড়ির তথ্য ডিজিটালি ধারণ করা হয়। প্রতিটি গাড়ি এন্ট্রিতে খরচের পাশাপাশি সময় আটভাগের এক ভাগে নেমে এসেছে।
শুল্কায়ন কার্যক্রম সঠিক ও দ্রুত করার জন্য একাধিক সংস্কার পদক্ষেপ গৃহীত হয়েছে। শুল্কায়ন দ্রুত করতে ফোল্ডার পদ্ধতি চালু করার ফলে একটি ফাইল নিষ্পত্তির প্রয়োজনীয় সময় ৩ দিনে থেকে তিন ঘন্টায় এসেছে। শুল্কায়ন গ্রুপ সংখ্যা ৫টি থেকে ৯টি বৃদ্ধি করা হয়েছে। শুল্কায়ন, মূল্যায়ন ও অডিটের ওপর নিয়মিত ইনহাউস প্রশিক্ষণ চলমান রয়েছে।
দেশের নিরাপত্তায় ও অবৈধ রাসায়নিক পণ্য চোরাচালান প্রতিরোধে চলতি বছরের জানুয়ারিতে কাস্টম হাউসে যুক্ত হয়েছে অত্যাধুনিক কেমিক্যাল ল্যাবরেটরি। আগে ছিল নামমাত্র যন্ত্রপাতি। আগে রাসায়নিক দ্রব্য পরীক্ষা করতে যেখানে ৭ থেকে ১৫ দিন লাগতো, সেখানে নতুন যন্ত্রপাতি সংযোজনের ফলে তা ঘণ্টায় নেমে এসেছে। সুত্র জানায় বর্তমান কমিশনারের উদ্যোগে ল্যাবরেটরিতে যুক্ত হয়েছে ১৮ ধরণের নতুন যন্ত্রপাতি। যন্ত্রপাতির মধ্যে রয়েছে এইচপিএলসি (হাই পারফরম্যান্স তরল ক্রোমাটোগ্রাফি), এফটিআইআর (ফোরিয়ার ট্রান্সফর্ম ইনফ্রারেড স্পিকারস অনুলিপি), মাইক্রোস্কোপ, ফ্ল্যাশ পয়েন্ট যন্ত্রপাতি, ওয়েল কনটেন্ট এনালাইজার, মিল্টিং পয়েন্ট যন্ত্র, কেজিডাহাল ফ্লাস্ক সেট, সুতা গণনা যন্ত্র, পলারি মিটার, ডেনসিটি মিটার, পিএইচ মিটার, কলারি মিটার, ভিসকো মিটার, হিটিং মিটার, ওয়াটার ডিসটিলাইমেন সেট, হট প্লেট, অগ্নি নির্বাপক যন্ত্র, হাজমাট আইডি এলিট এবং রোমান স্পেকট্রমিটার।
ঝুঁকি ব্যবস্থাপনায় গোয়েন্দা ও নিবারক তৎপরতায় ইনভেস্টিগেশন রিচার্স এন্ড ম্যানেজমেন্ট টিম গঠন করা হয়েছে। এনবিআর প্রদত্ত গাইডলাইনের আলোকে আইআরএম দলের প্রোফাইলিং ও নজরদারী বৃদ্ধি করা হয়েছে। জট কমাতে বন্দরে পণ্যবাহী গাড়ি প্রবেশ ও বের হওয়ার জন্য গেট সুনির্দিষ্ট করা হয়েছে। চোরাচালান প্রতিরোধে রাত্রিকালীন পেট্রোল টিম এবং বিশেষ ক্যাশ ক্লিয়ারেন্স টিম গঠন করা হয়েছে। এছাড়া জেলার ম্যাজিস্ট্রেটের সমন্বয়ে ডিসি কাস্টমসের মনেতৃত্বে বিজিবি, পুলিশ, আনসার ও র্যাবের সমন্বয়ে টাস্কফোর্স গঠন করা হয়েছে।
তথ্য, যোগাযোগ ও প্রযুক্তির উন্নয়নের অংশ হিসেবে স্টাফদের ডাটাবেজ তৈরির পশাপাশি হাজিরা নিশ্চিত করা হয়েছে। চোরাচালান প্রতরোধে অত্যাধুনিক সিসি ক্যামেরা স্থাপন করা হয়েছে। আমদানিকৃত গাড়িসহ বিভিন্ন পণ্য রাখার সুব্যবস্থা করতে বর্তমান কমিশনারের উদ্যোগে স্থল বন্দর কর্তৃপক্ষ ৭৫ বিঘা বা ২৫ একর জমি অধিগ্রহণ করেছে। ফলে মাল খালাসের আগে বিভিন্ন গাড়ি ও পণ্য বন্দরে রাখার অধিক সুবিধা পেয়েছেন আমদানিকারকরা। বড় বড় বহুজাতিক কোম্পানি বেনাপোল বন্দর দিয়ে তাদের আমদানি বাড়ানোর সুযোগ পেয়েছে।
সূত্রমতে, কাস্টমস কমিশনার বেলাল চৌধুরীর দক্ষ এবং চৌকশ নেতৃত্বে বেনাপোল কাস্টমস অতীতের যে কোন সময়ের চেয়ে বর্তমানে অধিক মুনাফা অর্জন করছে। শুল্ক ফাঁকি কমে যাওয়াতে জাতীয় রাজস্ব আয় বেড়েছে। কিন্তু আশংকা দেখা দিয়েছে রাজস্ব আয় কমে যাওয়ায়। বেলাল চৌধুরীসহ তার পুরো টিমকে বার বার মিথ্যা অভিযোগের মাধ্যমে হয়রানি করা হলে তারা কি হয়রানি মোকাবেলা করবে নাকি রাজস্ব আয়ে মনোনিবেশ করবেন? আমি বেলাল চৌধুরীকে ব্যক্তিগতভাবে চিনি না। ৯ আগস্ট ঢাকার একটি দৈনিকে ‘বিপুল অর্থবিত্তের মালিক বেলাল চৌধুরী’ শিরোনামে সংবাদ প্রকাশিত হয়। সংবাদে উল্লেখ করা হয় তার বাড়ি নোয়াখালীতে। প্রকাশিত সংবাদে নোয়াখালীতে বেলাল চৌধুরীর বিশাল সহায়-সম্পত্তি উল্লেখ করা হয়। আরও উল্লেখ করা হয় তার পরিবারসহ আরও অনেক তথ্য। আমি যেহেতু নোয়াখালীর একটি জনপ্রিয় দৈনিকের সম্পাদক তাই আমি আমার সমস্ত সোর্স প্রয়োগ করেও প্রকাশিত সংবাদের ১% সত্যতাও পাইনি। ১০ আগস্ট আমি আমার পত্রিকায় ‘ভায়াগ্রা গডফাদারদের অপপ্রচারের শিকার বেলাল চৌধুরী : প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা’ শিরোনামে ৬ কলামের লীড সংবাদ প্রকাশ করি।
রাষ্ট্রের একজন সচেতন নাগরিক হিসেবে সরকারের শীর্ষমহলে আমার নিবেদন থাকবে বেলাল চৌধুরীর প্রকৃতই দোষী হলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হউক। অন্যথায় বেলাল চৌধুরীর বিরুদ্ধে সকল অপপ্রচার বন্ধ করে রাষ্ট্রের স্বার্থে তাকে কাজ করার সুযোগ দেওয়া হউক। এর আগে ২০০৯ সালেও বেলাল চৌধুরীর বিরুদ্ধে দুদকে অভিযোগ করা হয়েছিল। তখন দুদক দীর্ঘ তদন্ত শেষে তাকে সকল অভিযোগ থেকে অব্যাহতি প্রদান করে। তখন তিনি চট্টগ্রাম কাস্টমসে কর্মরত ছিলেন। বর্তমানে তার বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগ এনবিআর-এর তদন্তে শতভাগ মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে। আমি মনে করি বেলাল চৌধুরীর মত সৎ, যোগ্য কর্মকর্তাকে কাজের সুযোগ করে দেয়া রাষ্ট্রের দায়িত্ব। রাষ্ট্র তার নিজ দায়িত্ব পালন না করলে বেলাল চৌধুরীর মত একজন সৎ-নিষ্ঠাবান কর্মকর্তার সেবা থেকে দেশ বঞ্চিত হবে, ক্ষতিগ্রস্ত হবে আমাদের আগামী প্রজন্ম।
লেখক : সম্পাদক, নোয়াখালী প্রতিদিন