ফ্রিতে সফটওয়্যার ও অ্যাপ ব্যবহারের মাধ্যমে পাচার করছি একান্ত গোপনীয় তথ্য

ফ্রিতে সফটওয়্যার ও অ্যাপ ব্যবহারের মাধ্যমে পাচার করছি একান্ত গোপনীয় তথ্য

নিজের তথ্য নিজের হাতে অন্যের কাছে পাচার করার ক্ষেত্রে এন্ড্রয়েড মোবাইলফোন ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম গুলো বিশেষ ভূমিকা রাখে। পাশাপাশি ই-কমার্স ও অনলাইন মাধ্যম গুলোর উপর অতিরিক্ত বিশ্বাস ও নির্ভর করায় দামি কিংবা কম দামি মোটামুটি সব ধরনের ব্যাক্তিগত তথ্য আমরা  অন্যকোন প্রতিষ্ঠান বা ব্যাক্তির কাছে অসাবধানতার কারণ বসত পাচার করে দিচ্ছি। নিজের নাম-পরিচয়, ছবি, পছন্দ, ভৌগোলিক অবস্থান, ব্যাংক হিসাব, লেনদেনের তথ্য অর্থাৎ দৈনন্দিন জীবনের বড় অংশের তথ্য অসচেতনতার ফলে এন্ড্রয়েডফোন বা স্মার্টফোন অথবা ইন্টারনেট ব্যবহারের মাধ্যমে অন্যকে জানিয়ে নিজের বড় সর্বনাশটা নিজেই করছেন। 
ভাবতে পারেন, কীভাবে? আপনি তো কখনো কাউকে কোনো তথ্য অপ্রয়োজনে  জানাননি, আপনি এক অর্থে ঠিক, কারণ আপনি কাউকে এমনিতেই কারন ছাড়া তথ্য দিয়ে আসেননি। প্রতিষ্ঠানগুলো আপনাকে ফ্রিতে কিছু সুবিধা দেওয়ার নামে কিছু শর্ত অনুযায়ী এ তথ্যগুলো নিয়ে নিচ্ছে। উদাহরণের মাধ্যমে স্পষ্ট হবেন বিষয়টি।
ইন্টারনেটে ফেসবুক ব্যবহার করেন না, এমন মানুষের সংখ্যা অনেক কম। স্কুল কলেজের পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের দেওয়া পাঠ, নোট  ও অন্যান্য তথ্য ছাত্রছাত্রীদের মাঝে সহজে পৌছে দিতে ফেসবুক ও অন্যান্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করা হচ্ছে। ছাত্রছাত্রীরা অ্যাপ বা সফটওয়্যার গুলো ইন্টারনেট থেকে ফ্রিতে নামিয়ে নিচ্ছেন। আপনি কি জানেন, গুগলের প্লে স্টোর থেকে যখন ফেসবুক অ্যাপটি নামান, তখন কতগুলো তথ্য তাদের দিয়ে দেন? এই অ্যাপ দেওয়ার বিনিময়ে ফেসবুক আপনার ডিভাইস ও অ্যাপের যাবতীয় তথ্য, আপনার পরিচয়, আপনার ফোনে থাকা নম্বর, নিজের ভৌগোলিক অবস্থান, ক্যামেরা ও মিডিয়ায় থাকা ছবি, ভিডিও ফাইলের তথ্য, কোন ডিভাইস থেকে কোথায় কাকে কল করেছেন এমন সব তথ্য নিয়ে নিচ্ছে। এমনকি বাসায় যে ওয়াই-ফাই ব্যবহার করেছেন তাতে প্রবেশাধিকারের অনুমতি নিয়ে নিচ্ছে। আপনি কিন্তু অ্যাপ বা সফটওয়্যার টি নামানোর সময় এত কিছু পড়ে দেখেন না বা পড়ার দরকার মনে করেন না বা অযথা সময় নষ্ট করতে চান না কিন্তু ডাউনলোড করার সময়  ‘অ্যাকসেপ্ট’ বা সম্মতি দেওয়ার বাটন আছে, দ্রুত সেটাতে চাপ দিয়ে ফেসবুক ডাউনলোড করে মনের আনন্দে ব্যবহার করতে শুরু করেন। এইরকম যতগুলো অ্যাপ বা সফটওয়্যার আপনি ব্যবহার করেন, ততগুলো প্রতিষ্ঠানের কাছে আপনি আপনার তথ্য নিজের অজান্তেই দিয়ে দিয়েছেন। আপনি কি ভাবতে পারেন জীবনে কতবার এই ‘অ্যাকসেপ্ট’ বা ‘আমি সম্মত’ বাটনে চাপ দিয়েছেন? তবে যতবার স্মার্টফোনের অ্যাপ নামানোর জন্য অ্যাকসেপ্ট’ বা ‘আমি সম্মত’ বাটনে চাপ দিয়ে অ্যাপ নামিয়েছেন, ততবার আপনার ব্যাক্তিগত ও একান্ত গোপন তথ্য পাচার করেছেন। আপনার স্মার্টফোনের কোনো তথ্যই আর আপনার কাছে রাখতে সংরক্ষিত বা গোপনীয় রাখতে পারেননি। শুধু তা-ই নয়, কোনো কোনো অ্যাপ ডিলিট বা মুছে ফেলার পরও আপনার তথ্যগুলো তাদের কাছে থেকে যায়।
একটি স্মার্টফোন নিয়ে ঘুরছেন মানে আপনি অনেকগুলো  অ্যাপ ব্যবহার করেন। আপনি ইন্টারনেট ব্যবহার করে এই অ্যাপ বা সফটওয়্যারের হিডেন বা লোকানো প্রযুক্তির মাধ্যমে আপনার ভৌগোলিক অবস্থান অ্যাপ সেবা গ্রহণকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে জানিয়ে দিচ্ছেন। উদাহরণ হিসেব, প্রায়ই দেখবেন আপনার মোবাইলে অথবা   ইমেইল ঠিকানায় অজানা কেউ বা কোন প্রতিষ্ঠান তার বা তাদের কাজ সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য দিচ্ছেন ও কেনাকাটার অফার দিচ্ছেন। এভাবে অপ্রয়োজনীয় বার্তা এসে আপনার মোবাইলের মেসেজ অপশন অথবা ইমেইলের ইনবক্স দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে। অনেক সময় আপনি কোনো রেস্তোরাঁয় খাওয়া সেরে বের হওয়ার পর সেটা সম্পর্কে আপনার মূল্যায়ন জানতে চেয়ে বার্তা আসছে অথবা কোন প্রতিষ্ঠান বা বিশেষ জায়গায় গেলে আপনার স্মার্টফোনে থাকা কিছু অ্যাপ আপনাকে নোটিফিকেশন দেয় বা কিছু নির্দেশনা দেয়। এমন অবস্থায় আপনি নিশ্চয়ই অবাক হন কারণ, আপনি হয়তো সেখানে গিয়ে সফটওয়্যারে  চেক-ইন দেননি কিংবা ফেসবুকে কোনো পোস্টও দেননি, তাহলে কীভাবে এটা হয়? হ্যা, আপনি নিজেই সফটওয়্যারকে ভৌগোলিক অবস্থান জানার সম্মতি দিয়ে এটার ব্যবস্থা করেছেন।
বিটিআরসি এর তথ্য মতে, বাংলাদেশে এখন পর্যন্ত মোবাইল ব্যবহারকারীর সংখ্যা ১৬ কোটি ২৫ লাখ ৮৩ হাজার এবং ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা ৯ কোটি ৮১ লাখ ৩৬ হাজার। তাদের মধ্যে ৯ কোটি ২৩ লাখ ৬১ হাজার গ্রাহক মোবাইল ইন্টারনেট ব্যবহার করে। এই তথ্য থেকে জানা যায়, বাংলাদেশের বিপুলসংখ্যক মানুষের ফোনে একাধিক অ্যাপ ব্যবহার করেন এবং এসব অ্যাপ সুবিধা নেওয়ার মাধ্যমে এই বিপুলসংখ্যক মানুষ তাদের গোপনীয় অনেক তথ্য বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কাছে স্বেচ্ছায় তুলে দিয়েছেন।
সফটওয়্যার বা অ্যাপের ব্যবহারের দরুন এই তথ্য পাচার কীভাবে রোধ করা যায় তা নিয়ে আমাদের যথেষ্ট ভাবতে হবে কারণ, দৈনন্দিন কাজের জন্য বিভিন্ন প্রয়োজনে আমাদের অ্যাপ তো ব্যবহার করতেই হয়। এ বিষয়ে সাইবার নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ জেসিকা বার্কার বিবিসি অনলাইনকে কিছু পরামর্শ দেন। তিনি বলেন, "সাইবার নিরাপত্তা বিষয়টি ইঁদুর-বিড়াল দৌড়ের মতো, এটা চলতেই থাকে। প্রযুক্তিরমাধ্যমে নিরাপত্তায় দুর্বলতা ধরা পড়ে এবং সেটার সমাধানের জন্য কাজ করা হয়। আবার নতুন ধরনের নিরাপত্তা ঝুঁকি তৈরি হয়, সে সমস্যারও সমাধান করা হয় এবং এভাবেই কাজটা এগিয়ে যায়। কেউই বলতে পারবেন না যে, তথ্য প্রযুক্তির ব্যবহারের মাধ্যমে নিরাপত্তার ঝুঁকি নেই এমন ডিভাইস তারা তৈরি করতে পেরেছেন। কিন্তু তারপরও আমাদের কিছু নিয়ম মেনে প্রযুক্তির ব্যবহার করতে হবে যেমন, সফটওয়্যার বা অ্যাপ ও অপারেটিং সিস্টেম নিয়মিত আপডেট করা, ভিন্ন ভিন্ন অ্যাপ ও সেবার জন্য ভিন্ন ভিন্ন পাসওয়ার্ড ব্যবহার করা, কোনো অ্যাকাউন্টে লগইন করার ক্ষেত্রে দুই ধাপের নিরাপত্তা পদ্ধতি অনুসরণ করা, যখন-তখন যেকোনো লিংকে ক্লিক না করা, অপ্রয়োজনে ও অযথা ইন্টারনেট ব্যবহার না করা, দরকার না হলে অযথা বিভিন্ন ওয়েবসাইট ভিজিট না করা ও লাইক বা কমেন্ট থেকে বিরত থাকা, খুব দরকার না হলে অযথাইন্টারনেট থেকে ডাউনলোড না করা এবং একান্ত ব্যক্তিগত ও গোপন তথ্য অনলাইন মাধ্যমে ব্যবহার না করার মাধ্যমে আমরা আমাদের প্রযুক্তির ব্যবহারকে অনেক সুরক্ষিত রাখতে পারি" বলে জানিয়েছেন এই তথ্যপ্রযুক্তিবিদ। এই বিশেষজ্ঞ সবচেয়ে বেশি জোর দেন ব্যক্তির সচেতনতার ওপর। কারণ, ব্যক্তি সচেতন হলে এতসব শর্ত মেনে এবং তথ্য অন্যের হাতে তুলে দিয়ে অ্যাপ নামাবেন না। অ্যাপ নামানোর হার কমলে প্রতিষ্ঠানগুলো এভাবে ব্যক্তিগত তথ্যে প্রবেশাধিকার চাওয়ার জায়গা থেকে পিছু হটতে বাধ্য হবে। এতে সুরক্ষিত হবে ব্যক্তির তথ্য। চারপাশে জোর চাপ সৃষ্টি হলে দেশগুলো জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক ফোরামে বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে বাধ্য হবে। এভাবেই হয়তো অ্যাপ সুবিধার বিনিময়ে ব্যক্তিগত তথ্য পাচার বন্ধ হবে।

আরও পড়ুন

×