প্রকাশিত: 10/01/2020
বেনাপোল-যশোর-খুলনা রুটে চলাচলকারী কমিউটার ট্রেনটি চোরাকারবারীদের নিরাপদ রুট হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে। অভিযোগ রয়েছে এসব চোরাকারবারীদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে সহযোগিতা করছে ট্রেনের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ও জিআরপি পুলিশ । কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে চোরাকারবারীদের কাছ থেকে ঘুষ বানিজ্যের অভিযোগ রয়েছে দীর্ঘদিনের। তবে ট্রেনের কর্তৃপক্ষ জিআরপি পুলিশ বরাবরের মত চোরাকারবারীদের কাছ থেকে ঘুষ নেওয়ার বিষয়টি অস্বীকার করেছে।
এই রুট দিয়ে নিরাপদে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে পৌঁছে যাচ্ছে ভারত থেকে চোরাই পথে আসা হেরোইন, ফেনসিডিল, গাঁজা, ইয়াবা, কসমেটিকস, ইমিটেশন গহনা, মসলাজাত দ্রব্য, শিশু খাদ্য, সার, কীটনাশক, বাজি, বোমা তৈরির সরঞ্জামসহ মারাত্মক অস্ত্র। চোরাকারবারীদের এসব পণ্য আসার প্রধান স্থানগুলো হলো বেনাপোলের দৌলতপুর, পুটখালী, গোগা, ভুলোট, কায়বা, রুদ্রপুর, ধান্যখোলা, ঘিবা, ও কাশিপুর সীমান্ত। চোরাচালান প্রতিহত করতে সার্বক্ষনিক দায়িত্বে রয়েছে পুলিশ তারপরেও চলছে অবাধে এসব ব্যবসা। আর এটাই প্রকৃত বা¯তবতা। চোরাচালানে সহায়তা করছে সীমান্তেÍর সিন্ডিকেটের মাধ্যমে মালামালের নিরাপত্তা সিøপ দিয়ে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার লোকজন উৎসাহিত করছে চোরাকারবারীদেরকে।
বেনাপোল থেকে খুলনা পর্যন্ত দিনে একবার যাতায়াত করতো কমিউটার ট্রেনটি। তবে যাত্রীদের দাবির ফলে বছর খানেক আগে একই ট্রেন প্রথমে সকাল ১০টা ১৫ মিনিটে বেনাপোল থেকে যাত্রী যশোরে নামিয়ে দিয়ে বেনাপোলে ফিরে আসতো। একই ট্রেন বেনাপোল থেকে দুপুর ২ টায় যাত্রী নিয়ে খুলনার উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করে। পরে আবার যাত্রীদের সুবিধার্থে ট্রেনটি সকাল ৯টার সময়ে বেনাপোল থেকে খুলনার উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করে। একই ট্রেন আবার বেনাপোল থেকে বিকেল ৫টায় খুলনার উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করে। তবে সেই ট্রেনটিতে যাত্রীদের কোন সুফল বয়ে আনতে পারেনি এখনো পর্যন্ত। পক্ষান্তরে চোরাকারবারীদের পাচারকারী বাহন হিসেবে বহুলাংশ ব্যবহৃত হচ্ছে। এ ট্রেনটিতে সাধারণ যাত্রী উঠলে চোরাকারবারীদের দ্বারা বিভিন্নভাবে লাঞ্ছিত হতে হচ্ছে। ট্রেনের বাথরুম থেকে সিটের নিচে, ওপরে মালামাল থাকে। এমনকি ট্রেনের সিলিং কেটেও তার মধ্যে মালামাল লুকিয়ে রাখে চোরাকারবারীরা। তবে সব দেখেও যেন না দেখার ভান করে ট্রেনে থাকা জিআরপি পুলিশ।
এ রুটে চোরাকারবারীরা বেনাপোল থেকে খুলনায় ট্রেনের ৬০ টাকা ভাড়া ১০ থেকে ২০ টাকা দিয়ে যাতায়াত করে থাকে। সড়ক পথে বেনাপোল চেকপোস্ট সীমাšত পার হলে যশোর-বেনাপোল সড়কের আমড়াখালি নামক স্থানে বিজিবি চেকপোস্ট, বেনাপোল বন্দর থানা, নাভারণ হাইওয়ে ফাঁড়ি, শার্শা থানা, ঝিকরগাছা থানা অতিক্রম করা ঝুঁকিপুর্ণ। অথচ ট্রেনের চোরাই পণ্য পরিবহন অনেক সহজলভ্য ও খরচ কম। একবার চোরাই পণ্য ট্রেনে তোলা হলে বেনাপোল থেকে যশোর, খুলনা আর কোথাও বাধা নেই, নেই কোথাও বিজিবি কিম্বা পুলিশ। ট্রেনের মধ্যে দায়িত্বে নিয়োজিত রেলওয়ে পুলিশ ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ নির্দিষ্ট হারে টাকা পেয়ে এসব চোরাকারবারী পণ্যকে বৈধতা দিচ্ছে। আর নির্দিষ্ট থানা পার হতে চোরাকারবারীরা থানার দালালদের দিচ্ছে টোপলা প্রতি ১০০ টাকা।
ট্রেনে চলাচলকারী যাত্রীরা জানান, চোরাকারবারীদের সাথে ট্রেনের চালকের আঁতাত থাকায় চালক স্টেশন থেকে ট্রেন ছাড়ার পরে যেখানে মালামাল থাকে সেখানে আস্তে চালায়। অনেক সময় চোরাচালানীরা ট্রেনের চেইন টেনে ধরে ট্রেন থামায়। আর এসময়ের মধ্যে চোরকারবারীরা তাদের মালামাল ট্রেনের দরজা-জানালা দিয়ে ছুঁড়ে ফেলে ট্রেনের মধ্যে। ট্রেন থামার স্থানগুলোর মধ্যে দিঘিরপাড়, কাগজপুকুর, ভবারবেড় পশ্চিম পাড়া, নাভারণ, নাভারণ ব্রিজের ওপর। তবে বর্তমানে বেনাপোল থেকে নাভারণ পর্যšত ট্রেনটিকে বিজিবি স্কট করার কারণে বেনাপোল থেকে মালামাল কম করে উঠায়। নাভারণ স্টেশন থেকে ট্রেনটি ছাড়ার পরে এক কিলোমিটার দূরে নাভারণ ব্রিজের কাছে গেলে ট্রেনের চেইন টেনে ট্রেনটি দাঁড় করানো হয়। এ সময়ে দ্রুত গতিতে চোরাকারবারীরা মালামাল উঠিয়ে নেয়।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে বেনাপোল কমিউটারের এক ট্রেনের চালক জানান, ‘আমরা ট্রেন রা¯তায় থামাই না। চোরাকারবারীদের এক দল স্টেশন থেকে ট্রেনে ওঠে। এর পর যেখানে যেখানে তাদের মালামাল থাকে সেখানে গিয়ে ট্রেনের হোর্সপাইপ খুলে দিয়ে হাওয়া ছেড়ে দেয়। ফলে সেখানে ট্রেন দাড়িয়ে গেলে চোরকারবারিরা খুবই দ্রুত মালামাল ট্রেনে উঠিয়ে নেয়। অনেক সময়ে চোরকারবারীরা ট্রেন দাঁড়ানোর জন্য পাথরও নিক্ষেপ করেন। এ অবস্থার মধ্যে আমাদের এ রা¯তায় ট্রেন চালাতে হয়। ট্রেনের মধ্যে রেলপুলিশ কি দায়িত্বপালন করেন তা জানতে চাইলে, তিনি বলেন, ট্রেনের রেলপুলিশ বগির মধ্যে কোন চোরাকারবারী কত বস্তা মালামাল উঠেছে তার টাকা তোলা নিয়ে ব্যাস্ত থাকেন।
বেনাপোল জিআরপি পুলিশের কর্মকর্তা কামাল হোসেনের কাছে ট্রেনে চোরাকারবারীদের নিকট থেকে টাকা উত্তোলনের বিষয়টি জানতে চাইলে তিনি বিষয়টি অস্বীকার করে বলেন, বেনাপোল-খুলনা কমিউটার ট্রেন নিয়ে অনেক লেখালিখি হয়েছে। তবে চোরাচালানী বন্ধ হয়নি। আপনি চেষ্টা করে দেখেন চোরাচালানী বন্ধ করা যায় কি না।
বেনাপোল শুল্ক ও গোয়েন্দা কর্মকতা তৃপ্তি রায় জানান, আমরা খুলনাগামী ট্রেন থেকে ১০ বস্তা আতশবাজী জব্দ করেছি। তবে ইনফরমেশন পেলে আমার ট্রেন তল্লশী করে থাকি।
বেনাপোল বিজিবির কম্পানী কমান্ডার আব্দুল ওহাব জানান, আমরা বেনাপোল থেকে ট্রেন ছাড়ার আগ পর্যন্ত স্টেশনে ডিউটি করে থাকি। ইতিমধ্যে ট্রেন থেকে বহু চোরাচালানী পণ্য আটক করা হয়েছে। এমনকি গতমাসে ট্রেন থেকে ২৭৫ বোতাল ফেনসিডিল জব্দ করা হয়েছে।