প্রকাশিত: 02/06/2020
‘কষ্ট করিয়া ট্যাকা জমে জতিম বোরো ধান আবাদ করছিলুম। ফলন ভালো হইছে। ধানোত কেবল পাক ধরছে। হঠাৎ অপরিকল্পিতভাবে আবাদি জমিতে যত্রতত্র পুকুর খননসহ পানি প্রবাহের মুখ বন্ধ হওয়ায় ৩ থেকে ৪ ফুট পানির নিচে তলিয়ে গেইল সউগ।
এ্যাল চলমো ক্যাংকা করি! খামো কী? ঋণ মেটামো কেমনে? প্রতিবছর সউগ ডুবি যায়। কাউ হামার কথা ভাবে না। কোমর পানিতে ধান কেটে আনার সময় কথাগুলো বলছিলেন কৃষক ইদ্রিস আলী।
১৫ বিঘা জমিতে বোরো চাষ করেছিলেন। কিন্তু বোরো ধান পানির নিচে তলিয়ে যাওয়ায় কমবেশি ১০ বিঘার ধান কাটতে কলাগাছের ভেলায় আনা সম্ভব হলেও ৫ বিঘার ধান কাটতে পারনেনি।
দিনাজপুরের ফুলবাড়ীতে অপরিকল্পিতভাবে আবাদি জমিতে যত্রতত্র পুকুর খননসহ পানি প্রবাহের মুখ বন্ধ হওয়ায় ৩ থেকে ৪ ফুট পানির নিচে তলিয়ে গেছে প্রায় ৭০০ একর জমির বোরো ধান গাছ। এতে আর্থিক লোকসানের পড়েছেন ১ হাজার বোরো চাষি।
গতকাল মঙ্গলবার সকালে সরেজমিনে উপজেলার ৫ নং খয়েরবাড়ী ইউনিয়নে মহদিপুর, কিসমত লালপুর, উত্তর লক্ষীপুর, পূর্ব নারায়ণপুর, অম্রবাড়ী, মহেশপুর এবং দৌলতপুর ইউনিয়নের বারাইপাড়া, গড়পিংলাই ও পলিপাড়াসহ কয়েকটি এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, ঘোনাপাড়া নামক স্থানে নিজ খেয়াল খুশি মতো ব্যক্তি বিশেষের উদ্যোগে আবাদি জমিতে অপরিকল্পিতভাবে যত্রতত্র পুকুর খনন করা হয়েছে।
এতে উত্তরের জমিগুলো থেকে গড়িয়ে পড়া পানি প্রবাহের পথ পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেছে। আম্পানের প্রভাবে তিনদিনের ঝড়োবৃষ্টিতে ওই এলাকার বোরো ধান গাছ ৩ থেকে ৪ ফুট পানির নিচে তলিয়ে গেছে।
এ অবস্থায় কৃষকরা তাদের ধান বাঁচাতে কলার ভেলাসহ ছোট নৌকা দিয়ে পানির মধ্যেই ধান কাটচ্ছেন। এতে করে মজুরি পড়ছে তিনগুণ বেশি।
মহদিপুর গ্রামের কৃষক মুশফিকুর রহমান বলেন, ১০ বিঘা জমির ধান পানির নিচে তলিয়ে গেছে। অতিরিক্ত অর্থ ব্যয়ে ৭ বিঘা জমির ধান কাটতে পারলেও পানির কারণে ৩ বিঘার ধান ফেলে আসতে হচ্ছে।
বারাইপাড়া গ্রামের কৃষক মুক্তার হোসেন বলেন, ৫ বিঘা জমিতে বোরো চাষ করেছিলেন। কিন্তু জলবদ্ধতার কারণে জমি পানির নিচে তলিয়ে যাওয়ায় ৩ বিঘার ধান কাটতে পারলেও ২ বিঘার ধান ফেলে আসতে হয়েছে।
মহদীপুর গ্রামের কৃষক মনছের আলী, একরামুল হক, নজরুল ইসলাম, আজমল হোসেনসহ শতাধিক কৃষক জানান, পূর্বে প্রবল বৃষ্টিপাত হলেও জমির পানি দক্ষিণে গড়িয়ে বের হয়ে যেতো।
কিন্তু ঘোনাপাড়া গ্রামে আবাদি জমিতে যত্রতত্রভাবে পুকুর খননসহ পানি প্রবাহের পথ কালভার্টের মুখ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় জমির ধানগুলো ডুবে গেছে।
এ অবস্থায় কৃষকরা যেটুকু ধান কাটতে পারছেন, সেগুলোর মধ্যেও অন্তত ৩০ ভাগ ধান নষ্ট হয়ে গেছে। বিষয়টি প্রতিকার চেয়ে
এলাকাবাসী একাধিকবার সড়ক অবরোধসহ সংশ্লিষ্ট দপ্তরে অভিযোগ দিলেও এখন পর্যন্ত কোন সুরাহা হয়নি। উপজেলার খয়েরবাড়ী ইউপি চেয়ারম্যান আবু তাহের মন্ডল বলেন, অপরিকল্পিতভাবে আবাদি জমিতে যত্রতত্র পুকুর খননসহ পানি প্রবাহের কালভার্টের মুখ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় দুই ইউনিয়নের ১ হাজার কৃষকের ৭০০ একর জমি পানির নিচে তলিয়ে থাকছে।
এতে করে চলতি বোরা মৌসুমে কৃষকরা কষ্ট করে ৪০০ একর জমিতে আবাদ করলেও ৩০০ একর জমি পড়েছিল। আবাদকৃত ৪০০ একর জমির মধ্যেও ১৫০ একর জমি পানির গভীরে তলিয়ে থাকায় সেগুলো পুরোপুরি নষ্ট হয়ে গেছে।
গত আমন মৌসুমেও ৪০০ একর জমিতে চাষাবাদ করা যায়নি। উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা এটিএম হামীম আশরাফ বলেন, তিন দফায় টর্নেডোসহ প্রবল বৃষ্টিপাতের খয়েরবাড়ী ও দৌলতপুর ইউনিয়নের ১০ থেকে ১২ টি গ্রামের ৬০০ একর বোরো ধান পানির নিচে তলিয়ে গেছে।
এতে বোরো ধানের পুরোপুরি ক্ষতি হয়েছে ১৮ একর জমির। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. আব্দুস সালাম চৌধরী বলেন, জলবদ্ধতা নিরসনের জন্য উপজেলা পরিষদ থেকে একটি প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে।
যা অনুমোদনের জন্য মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান মো. আতাউর রহমান মিল্টন বলেন, বিষয়টি নিরসনের জন্য একাধিকবার চেষ্টা করা হয়েছে।
কিন্তু মূল এলাকা বিরামপুর উপজেলায় পড়ার কারণে সেটি করা সম্ভব হয়নি। তবে উপজেলার সব কয়টি ইউপি চেয়ারম্যানদ্বয়ের সহযোগিতায় একটি বড় ধরনের প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে জলবদ্ধতার সমস্যাটি চিরতরে নিরসন হবে।