প্রকাশিত: 01/07/2020
মাঠ পর্যায়ে কাজ করতে গিয়ে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছিলেন চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. মাসুদুর রহমান। তাঁর সংস্পর্শে থাকায় পরে দুই শিশুপুত্রও আক্রান্ত হন। রোববার তিনজনকে সুস্থ ঘোষনা করে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স। ২৩ দিনের করোনা থেকে সেরে উঠার গল্প ফেসবুকে জানিয়েছেন ইউএনও। সোমবার(২২ জুন) সকালে নিজের আইডি থেকে স্ট্যাটাসটি দেন তিনি। তিনি লেখেন – ” গত ২৮ মে রাত থেকে হঠাৎ শরীর ব্যথা, কাশি ও সামান্য জ্বর অনুভূত হওয়ায় নাঁপা ট্যাবলেট খায়। কিন্তু রাত যত গভীর হচ্ছে শরীরের ব্যথা ও জ্বর বেড়ে চলেছে। সকালে উঠে ডাক্তারের পরামর্শে ওষুধ খাওয়া শুরু করলাম। ৩০ মে সকালে এক্সরে ও ব্লাড পরীক্ষা করলাম।এরপর স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে গিয়ে কোভিড ১৯ এর নমুনা দিলাম। নমুনা দেওয়ার আগে হাসপাতালে হঠাৎ শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে দেখে মুখের মাস্ক খুলে ফেললাম। ডাক্তারকে বললাম আমার খারাপ লাগছে, আমি ওয়াশরুমে যাব। আমি উনার ওয়াশরুমে গেলাম।বের হওয়ার পর দুইজন চিকিৎসক আমার কাছে আসলেন এবং একটি চেয়ারে বাইরে বসতে দিলেন। তারা দ্রুত পাল্স ওক্সিমিটার দিয়ে আমার পালস মাপলেন এবং বললেন সব ঠিক আছে। এরপর বাসায় এসে চিকিৎসক এর পরামর্শে ওষুধ খাওয়া, বাসায় ঘরোয়া চিকিৎসা দুটোই শুরু করলাম। আমার দুই ছেলের সাথে খেলাধুলা করছি , খাচ্ছি। সবকিছু স্বাভাবিকভাবেই চলছে। ১ জুন বিকেলে ছেলেদের নিয়ে বাসার ছাদে হাঁটাহাঁটি করছি। ঠিক তখনই একটা ফোন আসলো এবং বললো, স্যার, আপনি কোথায়? আমি বললাম বাসার ছাদে। তিনি বললেন আপনি এখনই আইসোলেশনে চলে যান।
আমি তা বুঝার বুঝলাম, তিনি আমাকে বলতে চাননি। আমার স্ত্রীর সাথে কথা বললেন ওই চিকিৎসক। আমি যখন একটি কক্ষে গেলাম আমার দুই ছেলের সে কি কান্না। বাবা, দরজা খুলছে না কেন? আমার দুই ছেলে আমাকে ছাড়া ঘুমাবে এটা তারা কখনো কল্পনাও করতে পারেনা বলে আমার বিশ্বাস। আমার স্ত্রী কি করবে ভেবে পাচ্ছেনা। কিন্তু সে ভেঙে পড়েনি। বাচ্চাদের খাওয়া, গোসল করানো, রান্না, আমার খাওয়া, পানির ভাপ নেওয়ার বিষয়ে, সব কিছু নিয়ে সে ব্যস্ত। হঠাৎ লক্ষ্য করলাম বাচ্চাদের হাঁচি এবং কাশি হচ্ছে। চিকিৎসক এর সাথে আলাপ করে ২ জুন বাসার সবার নমুনা পরীক্ষার জন্য দিলাম। ৩ জুন সন্ধ্যায় জানলাম, আমার ছেলে ও গৃহপরিচারক এর নেগেটিভ কিন্তু আমার অবুঝ দুটি শিশু সন্তান করোনা পজিটিভ। অর্থাৎ আমরা বাপ ছেলে তিনজন পজিটিভ।আইসোলেশন ছেড়ে পরিবারের সকলের সাথে মিশে গেলাম। রাত দশটায় বড় ছেলের ( তিন বছর দশ মাস) জ্বর আসলো।ভয় পেয়ে গেলাম। যাই হোক বাসায় ওষুধ ছিল, খাইয়ে দিলাম।রাতে জ্বর আরো বেড়ে গেল । আবার নাঁপা খাওয়ালাম, এরপর কুসুম গরম পানিতে গামছা ভিজিয়ে শরীর মুছতে থাকলাম।ভোরে জ্বর কমলো। তারপর নামাজ পড়ে ঘুমানোর চেষ্টা করলাম কিন্তু ঘুম আসছিলো না। দুপুরে তার আবার জ্বর আসলে নাঁপা খাওয়ানোর পর জ্বর কমে গেল। হালকা কাশি ও হাঁচি দিচ্ছে মাঝে মাঝে।ছোট ছেলের শুধু হাঁচি ও কাশি ছিল। ছেলেদের পজিটিভ আসার পর আমি ভয় পেয়ে গেলাম কিন্তু আমার স্ত্রী সাহসিকতার সাথে পরিস্থিতি সামাল দিচ্ছেন। জানি ভিতরে ভিতরে সে চরম মানসিক ভাবে ভেঙে পড়েছেন কিন্তু কাউকে বুঝতে দেয়নি। বুকে চাপ অনুভব করায় দুই দিন ইসিজি করালাম, চিকিৎসক আমাকে হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার জন্য বারবার অনুরোধ করছেন। দুই দিন অ্যাম্বুলেন্স এসেছে আমাকে নেওয়ার জন্য কিন্তু স্ত্রী যেতে দেয়নি। তাছাড়া আমারো মন সাড়া দেয়নি।কারণ আমার অক্সিজেন হলো আমার দুই কলিজার টুকরা ছেলে। আমি চলে গেলে ছেলে এবং আমার স্ত্রী আরো ভেঙে পড়বে এবং বড় বিপদ হতে পারে ভেবে হাসপাতালে যাইনি। যাই হোক আমি এগুলো লিখছি এই কারণে যে, এই মুহূর্তে আমাদের দেশে প্রায় ঘরেই জ্বর,সর্দি কাশির রোগী আছে। আমার এই অভিজ্ঞতা তাদের যদি কোন কাজে আসে। আমি যা করেছি:
জ্বর আসার দ্বিতীয় দিন চিকিৎসকের পরামর্শে ইভেরা ১২ এমজি খেয়েছি,
নাঁপা খেয়েছি, জিম্যাক্স ৫০০ এমজি দিনে একটি করে সাতদিন,ডকোপা -২০০ ট্যাবলেট সকালে ও রাতে কাশির জন্য
মোনাস ১০ রাতে চুষে খেয়েছি, কেভিক সি দিনে একটি পানিতে গুলে খেয়েছি
সিভিট দিনে তিন চারটি খেয়েছি,
জিংক সকাল বিকাল দুটি,
মাল্টিভিটামিন সকল ওষুধ চিকিৎসক এর পরামর্শে খেয়েছি। দয়া করে কেউ নিজে নিজে ঔষধ খাবেন না। অবশ্যই করোনার লক্ষণ দেখা দিলে চিকিৎসকের পরামর্শে ঔষধ সেবন করবেন। এর বাইরে আমি দিনে দশ মিনিট করে গরম পানির ভাপ নিয়েছি চার, পাঁচ বার, মসলা চা দুই বার, লেবু, মাল্টা,আম পর্যাপ্ত পরিমাণে খেয়েছি। দুটি সেদ্ধ ডিম,দুধ,সুপ, মুরগি, সবজি,মধু, কালোজিরা খেয়েছি। চেষ্টা করেছি প্রতিদিন ছাদে আধা ঘন্টা রোদে হাঁটাহাঁটি বা হালকা দৌড়াতে। বাসায় হেঁটেছি। বাচ্চাদের সাথে খেলেছি। রাতে ঘুম হতো না ভয়ে। অনেক চিকিৎসক আমাকে মানসিকভাবে সাপোর্ট দিয়েছেন।
বাচ্চাদের চিকিৎসার বিষয়ে যা করেছি:
ওদের জন্য আলাদা চিকিৎসা ছিল না। জ্বর থাকলে নাপা খাওয়াতাম না হলে না। জিংক সিরাপ, মোনাস ট্যাবলেট, সিভিট,লেবুর জুস,আম ও মাল্টার জুস, দুধ, রং চা ,মধু, কালোজিরা এবং স্বাভাবিক খাবার।তবে সবকিছু ছাড়িয়ে আমাদের সুস্থতার জন্য আল্লাহর নিকট লাখো কোটি শুকরিয়া। সর্বস্তরের মানুষের দোয়া ও ভালোবাসা এবং আমাদের অক্সিজেন ছিল আমার দুই ছেলে ও আমার স্ত্রী। আরেকজনের কথা না বললেই নয়, সে হলো আমার গৃহপরিচারক তরুন অভি দাস । সে এতো কিছুর পরেও ভয় না পেয়ে আমার ছেলেদের আগলে রেখেছেন। যেখানে করোনার কথা শুনলে সন্তান পিতা মাতার কাছে আসতে ভয় পায়, আত্মীয়স্বজন কাছে আসেনা। আল্লাহ, আমাদের সহায় ছিলেন, আমাদের শেফা দান করেছেন। আলহামদুলিল্লাহ, আমরা সবাই সুস্থ আছি। আপনারা ভালো থাকবেন।
সবাই স্বাস্থ্য বিধি মেনে চলুন। জানতে চাইলে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের চিকিৎসা কর্মকর্তা ও করোনা বিষয়ক ফোকাল পার্সন মো. ফোরকান উদ্দিন সিকদার বলেন, ” ইউএনও মহোদয় ও তাঁর দুই শিশুপুত্রের শুরু থেকে করোনা উপসর্গ ছিল। উপসর্গ অনুযায়ী তাঁদের চিকিৎসা দেয়া হয়েছে।