এক বোন তো মাটি চাপায় মইল, হামারো মরণ ওংকাই হবে

এক বোন তো মাটি চাপায় মইল, হামারো মরণ ওংকাই হবে

মোর বইন যখন মাটি চাপায় মইল, তখন তো সব্বাই ফোটো তুইল্যা নিয়া গেইল্যো। কই আজো তো দেখনু না, কেউ হামার পাশোত দাঁড়াইল। ভাঙা মাটির ঘরোত যেংকা করি হামার বোন মইল, হামারো মরণ ওংকাই হবি। এখন হামার ফোটো আর তুইল্যেন না তোরা। কেউ কিছু করবার পাইবেন না। হারাও যখন মরি পরি থাকিম বইনের নাখান, সেদিন আইস্যেই হামার ফোটো তুলবার।

এমনটাই বলছিলেন দিনাজপুরের ফুলবাড়ী পৌরএলাকা প্রতিবন্ধী পরিবারটির কর্তাব্যক্তি মানসিক প্রতিবন্ধী দুলাল চন্দ্র রায় (৬৫)।

দুলাল চন্দ্র রায় (৬৫), মাধব চন্দ্র রায় (৬৩), কানাই চন্দ্র রায় (৬০), গোপাল চন্দ্র রায় (৫৮), শেফালী রানী রায়, (৫৫), বলাই চন্দ্র রায় (৫৩) এবং জ্যোৎ¯œা রানী রায় (৫০)। সাত ভাইবোন তাঁরা। তাঁদের মধ্যে বলাই চন্দ্র রায় শারিরীক ও মানসিকাভাবে ভালো থাকায় অন্যখানে নিজ সংসার করেন এবং চলতি বছরের ৩১ জুলাই মাটির ঘরের দেয়াল চাপা পড়ে মারা যান শারীরিক প্রতিবন্ধী জ্যোৎ¯œা রানী। বর্তমানে তাঁর পরিবারে চারজন শারীরিক ও মানসিক প্রতিবন্ধী এবং একজন হৃদরোগী ভাইবোন নিয়েই তাঁর সংসার। তাঁদের মধ্যে শুধুমাত্র দুলাল চন্দ্র রায় পান বয়স্কভাতার কার্ড। 

জানা যায়, পৌরএলাকার পুরাতন বন্দরে ছিল তাদের বাসাবাড়ি। তাদের দাদা ছিলেন ব্রিটিশ আমলের ফুলবাড়ী পোষ্ট মাষ্টার এবং বাবা ফনী মোহন রায় ছিলেন শিক্ষক। একসময় তাদের ছিল ২১ একর (৬৩ বিঘা) জমি। থাকতো গোলাভরা ধান, ছিল গোয়াল ভর্তি গরু-মহিষ ও ছাগল, আরো ছিল পুকুর ভর্তি মাছ। বাড়িতে ছিল চাকর-বাকরের ভিড়। কোনকিছুরই কমতি ছিল না তাদের। 

মুক্তিযুদ্ধের পরপরই পুরাতন বন্দর ছেড়ে পৌরএলাকার পূর্ব কাটাবাড়ী গ্রামে চলে আসেন তাঁরা। ১৯৮৪ সালে জমিজমা সংক্রান্ত কারণে দুষ্কৃতিদের হামলায় নিহত হন তাদের বাবা। বাবা নিহতের পর দালালদের খপ্পড়ে পড়ে জমিজমা হারিয়ে সর্বস্বান্ত হন তারা। তখন থেকেই দুর্বিষহে জীবনযাপন শুরু হয় তাদের। দুশ্চিন্তায় হারিয়ে যায় তাদের মানসিক ভারসাম্য। খাবার ও পুষ্টির অভাবে শারীরিক প্রতিবন্ধকতায় রূপধারণ করে তাদের শরীরে। বর্তমানে তাদের বেহাল দশার চিত্র দেখার কেউ নাই। 

পৌরএলাকার পূর্ব কাঁটাবাড়ী গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, ৭ শতক জমিতে রয়েছে ভাঙা মাটি ও টিনের চালার ঘর। প্রথমে ঘরটি দেখে গোয়াল ঘর মনে হলেও কাছে গিয়ে দেখা যায়, সেখানে কয়েকজন বসে আছেন। দেখে বোঝার উপায় নেই সেখানে কোন মানুষের বসবাস রয়েছে। ওই ভাঙা মাটির ঘরে রয়েছেন মানসিক ও শারীরিক প্রতিবন্ধী ওই ভাইবোনগুলো। 

আঙিনায় রয়েছে দুটো গরু বাঁধা। খোলা আকাশের নিচে শাক-পাতা রান্না করছেন শারীরিক প্রতিবন্ধী শেফালী রানী রায়, গরুগুলো খাবার দিচ্ছেন হৃদরোগী কানাই চন্দ্র রায়। দুর্বিষহ জীবনের চিত্র দেখা যায় সেখানে।

হৃদরোগী কানাই চন্দ্র রায় অশ্রæ চোখে বলেন, ‘আমরা সাত ভাইবোন। একসময় অনেক সম্পত্তি মালিক ছিলাম আমরা। দালাল চক্রের খপ্পড়ে পড়ে বর্তমানে সর্বস্ব হারিয়ে সর্বস্বান্ত হয়ে গেছি। সেই চিন্তায় মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে এবং খাবার ও পুষ্টির অভাবে প্রতিবন্ধতকার কবলে পড়ে আমার পাঁচ ভাইবোন। আমার ছোটভাই বলাই ভালো হওয়ায় পুরাতন বন্দরে বিয়ে করে নিজের সংসার করছে। আর আমি বাজার কাঁচাবাজারের ব্যবসা করতাম। তা দিয়েই চালিয়ে যাচ্ছিলাম প্রতিবন্ধী ভাইবোনের সংসার। 

কিন্তু গত চারবছর পূর্বে আমি হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে শারীরিকভাবে ভেঙে পড়ি। বর্তমানে অন্যের দোকানে কাজ করে এবং বড় ভাইয়ের বয়স্ক ভাতার টাকাসহ মানুষের সহযোগিতা নিয়ে দিন কাটছে আমাদের। প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি কামনা করছি’

প্রতিবেশী আনোয়ার হোসেন ও কমলেশ রায় বলেন, ‘আমরা ছোট থেকেই তাঁদের দুর্দশার জীবন দেখে আসছি। প্রধানমন্ত্রীর সুদৃষ্টি কামনা করছি, যাতে তার দৃষ্টিতে আসে ওই প্রতিবন্ধী পরিবারটি।’

এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট ওয়ার্ড কাউন্সিলর আবু ফরহাদ বাবু বলেন, ‘যখন বাড়ির তালিকা করেছি তখন তাদের কাছে কাগজ চেয়েছিল তারা কাগজপত্র দেয়নি তাই তাঁদের নাম তালিকাভূক্ত করা সম্ভব হয়নি। পরবর্তীতে তাঁদের নাম তালিকভুক্ত করব।’

ফুলবাড়ী উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা বলেন, ‘বিষয়টি ইউএনওর নজরে এসেছে তিনি প্রস্তার পাঠাবেন।’ 

ফুলবাড়ী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. রিয়াজ উদ্দিন বলেন, ‘বিষয়টি আমি জেনেছি। বর্তমানে ঘর নির্মানের যে তালিকা হয়েছে; আমি খোঁজ নিয়ে জেনেছি সেখানে ওই প্রতিবন্ধী পরিবারের নাম নেই। আগামীতে যখন সুযোগ আসবে তখন তাঁদের নাম দেওয়া হবে।’ 
 

আরও পড়ুন

×