প্রকাশিত: 10/11/2020
নাসিমা পারভীন। বয়স ৫০ ছুঁই ছুঁই। প্রথম স্বামী ছেড়ে যান তাকে। অল্প বয়সেই সংসারের পুরো দায়িত্ব কাঁধে পড়ে তাঁর। এক ছেলে ও এক মেয়েকে নিয়েই অথৈ সমুদ্রে একাই পথ চলতে শুরু করেন তিনি। আত্ম সম্মানের কথা ভেবে বাবার বাড়িতেও যেতে নারাজ ছিলেন নাসিমা। স্রোতের বিপরীতে দাঁড় বেয়ে সন্ধান করেন কূলের কিন্তু কূল কিনারা না পেয়ে তার ছেলে মেয়েকে নিয়েই এগিয়ে যেতেই থাকেন।
নিজ উপার্জিত অর্থে জমিজমা কিনে ঘরবাড়ি নির্মাণ করেন ছেলে মেয়েকে নিয়ে থাকতেন নাসিমা। হঠাৎই সন্ধান পান শাহিদুর রহমান নামের এক ব্যক্তির। পথসঙ্গী হিসেবে পেয়ে অবশেষে জীবনসঙ্গী করে ফেলেন তাকে। গল্পটা দিনাজপুরের ফুলবাড়ী পৌরএলাকার কাঁটাবাড়ী গ্রামের নাসিমা পারভীনের।
নাসিমার আজকের অবস্থানে আসার গল্পটা রীতিমতো এভারেস্ট জয়ের মতোই। বিভিন্ন বাঁধাপ্রতিকূলতাকে পেরিয়ে আজ এই অবস্থানে এসেছেন তিনি। নাসিমা পূর্বে জানা হস্তশিল্পের মাধ্যমেই নিজেকে করে তুলেন। নাসিমা পারভীনের স্বপ্ন সমাজে ঝরে পরা নারীদেরকে নিয়েই তিনি সামনে এগিয়ে যাবেন। সেই স্বপ্ন মতেই তাদেরকে স্বাবলম্বী গড়ে তোলার দীর্ঘ ১০ বছর থেকেই উদ্যোক্তা হিসেবে কাজ করে আসছেন।
যেই ভাবনা সেই কাজ। আত্মপ্রত্যয়ী নাসিমা শুরু করেন স্বপ্নের ফুল ফোটাতে। সে সময় দৃঢ় মনোবল ও সাহসই ছিল তাঁর বড় সঙ্গী। তাঁর চিন্তাচেতনায় ছিল সমাজে ঝরে পড়া নারীদেরকে সমাজে এগিয়ে এনে তাদেরকে কর্মমূখী করে তোলা। সেই উদ্দ্যেশেই ২০০৫ সালে এবং ২০০৯ সালে দুইটি সামাজিক সংগঠনের রেজিষ্ট্রেশন অর্জন করেন তিনি। এরপর পুঁজি আর জনবল নিয়ে ২০১২ হাজার সালে শুরু করেন ‘রোশনী’ নামে ক্ষুদ্র একটি সেলাই কারখানার যাত্রা।
এরপর ২০১৮ সালে নারী কল্যান সমিতি এ- বুটিকস্ধসঢ়; হাউজ নামের একটি সংস্থার রেজিষ্ট্রেশন নেন তিনি। সেখানে সুইসুতা, বুটিকস, এ্যাথলেটিক্স, ক্রিস্টাল শোপিচ, সেলাই ও দর্জি বিজ্ঞান ইত্যাদি পণ্য তৈরি এবং প্রশিক্ষণ প্রদান করছেন করছেন নাসিমা। এ বাদেও তিনি নিজ বাড়িতে দেশি মুরগী পালন ও বিভিন্ন প্রজাতির মাছ চাষ করছেন।
জানা যায়, নাসিমা পারভীনকে দেখে অন্য নারীরাও নিজেদেরকে স্বাবলম্বী করে তুলতে নাসিমার কাছে গিয়ে বিভিন্নপ্রকার পরামর্শ গ্রহণসহ তাঁর কাছে কাজ শিখেন ওইসব নারীরা। ১৫ জনের ব্যাচ করে ৪৫ দিনের বিভিন্ন কোর্সের ওপর প্রশিক্ষণ প্রদান করছেন নাসিমা পারভীন। এছাড়াও ওই নারীরা নাসিমা পারভীনের কাছে সঞ্চয় গড়ে তুলছেন এবং পরবর্তীতে সেই সঞ্চয়ের অর্থে নিজেরাই উদ্যোক্ত
হিসেবে পরিচিতি লাভ করছেন। এ পর্যন্ত তিন শতাধিক নারীরা প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেছেন। এদের মধ্যে ২৫ জন নারী এখন নিজেরাই উদ্যোক্তা। তারা স্বাবলম্বী। নাসিমার কাছে প্রশিক্ষণগ্রহণকারী জান্নাতুন ফেরদৌস, দেলোয়ারা দুলি ও সুইটি বেগম বলেন, ‘ নাসিমা শুধু নিজের অবস্থানের পরিবর্তন করেই ক্ষান্ত হন’নি।
তিনি চেয়েছিলেন সমাজে ঝরে পড়া নারীদের এগিয়ে নিতে। আমরা বিভিন্নভাবে ঝরে পড়ার উপক্রমে দাঁড়িয়েছিলাম। ঠিক সে সময়ে হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন নাসিমা। তাঁর হাত ধরে আজ আমরা স্বাবলম্বী আমরা বিভিন্ন হস্তশিল্পের কাজ শিখেছি। সেই কাজের মাধ্যমে আমরা এখন অর্থ উপার্জনক্ষম।
আমাদেরকে কর্মমূখী করে সমাজে পরিচয় বহণের সক্ষমতা দিয়েছেন নাসিমা আপা।’ নাসিমার গল্পটি যত সহজে বলা গেল বাস্তবতা অতটা মমৃণ ছিলোনা তাঁর জন্য। চোখ মুছে নাসিমা বলেন, ‘নারী হিসেবে ব্যবসা করার বিষয়টি সমাজ খুব সহজ ভাবে মেনে নেয় না। আমি যখন শুরু করি তখন; পরিবার থেকেও সে সময় কেউ পাশে দাঁড়ায়নি।
আমার উদ্দেশ্য ছিল নিজে প্রতিষ্ঠিত হব এবং সমাজের ঝরে পড়া নারীদেরকে সমাজে প্রতিষ্ঠিত করে তুলব। সেই উদ্যোশ্যানুযায়ীই আজ আমি নিজে প্রতিষ্ঠিত এবং সমাজের অন্যান্য নারীদেরকে প্রতিষ্ঠিত করার লক্ষ্যে দিনরাত কাজ করছি। আমাকে সাথে সার্বক্ষণিকভাবে জান্নাতুন ফেরদৌস, দেলোয়ারা দুলি, সুইটি বেগম, আজরিনা, লায়লা ও মেঘলা সাহা সহযোগিতা করে যাচ্ছে।
তাদের সহযোগিতায় আমার পথ আরো সহজ হয়ে উঠেছে।’ ফুলবাড়ী উপজেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা রীতা ম-ল বলেন, ‘নাসিমা বেগমের কর্মকা- আসলেই প্রশংসনীয়। তিনি বিভিন্ন বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেন বিশেষ করে নারীদের আত্মকর্মসংস্থানের বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ উনার সংগঠনের।
নাসিমা সুইসুতা, বুটিকস, এ্যাথলেটিক্স, ক্রিস্টাল শোপিচ, সেলাই ও দর্জি বিজ্ঞানসহ মুরগী ও মাছ চাষের প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন। তাঁর কাচে প্রশিক্ষণ নিয়ে প্রতিবছর বহুনারী স্বাবলম্বী হচ্ছেন। নাসিমা বিভিন্ন জনবল নিয়ে মহিলা বিষয়ক অধিদফতের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে অংশ নেন এবং নারী ক্ষমতায়ন সম্পর্কে ওইসব নারীদেরকে উদ্বুদ্ধ করেন। তাকে দেখে সমাজের অনেক নারী নিজেরাই প্রতিষ্ঠিত হওয়া স্বপ্ন বুনছেন।