প্রকাশিত: 24/04/2021
হৃদয়বিদারক রানা প্লাজা ধসের স্মৃতি এখন অনেকটা ধূসর। ১৪ এপ্রিল আজকের এইদিনে ২০১৩ সালের ঘটেছিল পৃথিবীর ইতিহাসের তৃতীয় বৃহত্তম দুর্ঘটনা। রানা প্লাজার নয় তলা ধসে নিহত হয়েছিলেন ১ হাজার ১৩৪ জন আর আহত হয়ে পঙ্গুত্ব বরণ করেছেন হাজারো পোশাক শ্রমিক।
আজ সেই দুর্ঘটনার আট বছর পূর্ণ হলেও বিভীষিকাময় দুর্ঘটনার স্মৃতি আজো তারা করে দুর্ঘটনায় পঙ্গুত্ববরণকারীদের। তাদের মধ্যেই অন্যতম একজন দিনাজপুরের ফুলবাড়ীর রেবেকা বেগম। তিনি সেই দুর্ঘটনায় হারিয়েছেন মা, দুুই দাদী ও দুই চাচাতো ভাই ও বোনকে। একইসাথে হারিয়েছেন তার দুইটি পা।
রেবেকা বেগম ফুলবাড়ী উপজেলার আলাদীপুর ইউনিয়নের বারাই চেয়ারম্যানপাড়া গ্রামের রাজমিস্ত্রি মোস্তাফিজুর রহমানের স্ত্রী। সরেজমিনে বারাইহাট গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, স্বামী মোস্তাফিজুর রহমান, মেয়ে মিজরাতুল মুনতাহা (৬) ও ছেলে মাদানি আন নূরের (২) পাশে বসে নতুন বাড়ি নির্মাণের কাজ দেখছেন রেবেকা বেগম। রেবেকার নতুন বাড়ির স্বপ্নটি পূরণ করেছে বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাক। ওই সংস্থাটির কাছে আবেদন করেই নতুন পাকা বাড়ি পেয়েছেন তিনি।
তিনি বলেন, রানা প্লাজা পোশাক কারখানায় আমিসহ আমারা দুই দাদি, মা, দুই চাচাতো ভাইবোন ও এক ফুফু শ্রমিক হিসেবে কর্মরত ছিলাম। হঠাৎ করেই ওই ভবনে ফাটল দেখা যায়, বিষয়টি কর্তৃপক্ষকে বলা হলে তিনি বলেন কিছু হবে না তোমরা কাজে যাও, নয়তো চাকরি থেকে বের করে দেব।
চাকরি হারানোর ভয়ে হাজারো শ্রমিকের মতো আমরাও কর্মে চলে যাই। কাজ করতে করতে হঠাৎ করেই ভবনটি ধসে পড়ে। তারপর আর কিছুই বলতে পারিনা.......। যখন জ্ঞান ফিরে তখন দেখি আমার দুইপা ভবনের স্তুপের নিচে চাপা পড়ে আছে। আমার আর্তনাদ শুনে উদ্ধার কর্মীরা আমার কাছে ছুটে আসে এবং আমার অবস্থা জিজ্ঞেস করেন।
আমি বলি আমার দুই পা চাপা পড়ে আছে, আমার স্বামী রাজমিস্ত্রি সে পাশের এলাকাতেই আছে আপনারা তাকে ফোন করে ডাকেন এবং আমাকে উদ্ধার করতে বলেন। তাদেরকে আমি আমার স্বামীর নাম্বার দেই তারপর আমার স্বামী ছুটে আসে। উদ্ধারকর্মীদের সহযোগিতায় আমাকে উদ্ধার করে হাপাতালে নিয়ে যায়।
পরে বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য নেওয়ার পর একটি হাসপাতালে আমার দুই পা কেটে ফেলে দেয়। এখন পর্যন্ত আটবার আমার পা কাটতে হয়েছে। বর্তমানে আবারো হাড্ডি বৃদ্ধি পেয়ে অসহ্য বেদনায় থাকতে পারছি না। আবারো হাড্ডি কাটতে হবে। তিনি অশ্রু চোখে বলেন, আমি আমার দুই পা হারিয়ে ফেলি সাথেই জানতে পারি আমার মা, দুই দাদি এবং দুই চাচাতো ভাইবোন আর বেঁচে নেই।
শুধু আমি আর আমার ফুফু বেঁচে যাই। সেইদিনের দুর্ঘটনার কথা মনে পড়লেই আমার বুক ফেটে কান্না ঝরে। তিনি আরো বলেন, আহত শ্রমিকদের যারা শরীরের দুইটি অঙ্গ হারিয়েছেন তাদেরকে ১৫ লাখ টাকা করে দেওয়া হলেও, আমার একটি অঙ্গ হারিয়েছে এমন রিপোর্ট দেওয়ায় আমাকে ১০ লাখ টাকা প্রধানমন্ত্রীর ত্রাণ তহবিল থেকে দেওয়া হয়। আমার দুইটি পা হারিয়েছি আমি প্রধানমন্ত্রীর কাছে বিনীত অনুরোধ করব, আমাকে বঞ্চিত করা হয়েছে। আমার পাওনা আমাকে ফিরিয়ে দিন।
রেবেকার স্বামী রাজমিস্ত্রি মোস্তাফিজার রহমান বলেন, সেই দুর্ঘটনার স্মৃতি আজো রেবেকাকে তাড়া করে বেড়ায়। মাঝেমধ্যেই রেবেকা বুকফাটা কান্নায় ভেঙে পড়ে। ছেলে মেয়েদের দুশ্চিন্তায় ঘুমায় না রাতে। সেই দুর্ঘটনাটাই আমাদের সুন্দর সংসার তছনছ করেছে। দুর্ঘটনায় প্রধানমন্ত্রীর তহবিল থেকে ১০ লাখ টাকা পেয়েছে রেবেকা। সেই টাকা স্থায়ী আমানত হিসেবে দিনাজপুর শাখা সোনালী ব্যাংকে আছে।
সেই টাকা দিয়েই কোনমতে সংসার চলছে। স্ত্রীসহ ছোটছোট ছেলে-মেয়েকে দেখাশোনা করার জন্য বাহিরে কাজে যেতে পারিনা। কেউ আর খোঁজ নেয় না রেবেকা কেমন আছে। তবে আমাদের পাশে ব্র্যাক আছে। তারা বিভিন্নভাবে আমাদেরকে সহযোগিতা করে আসছে এমনি রেবেকাকে কৃত্রিম পা দিয়েছে ব্র্যাক। এছাড়াও দুই কক্ষ বিশিষ্ট একটি পাকা বাড়ি বানিয়ে দিয়েছে ব্র্যাক সংস্থাটি।
আগামী ২৪ এপ্রিল আনুষ্ঠানিকভাবে সেই বাড়িটি আমাদেরকে হস্তান্তর করা হবে। ব্র্যাকের আঞ্চলিক ব্যবস্থাপক আশরাফ হোসাইন বলেন, ইতোপূর্বেও রেবেকার পাশে ছিল ব্র্যাক, আজো আছে। তার আকুল আবেদনে তাকে সাড়ে সাত লাখ টাকা ব্যায়ে একটি বাড়ি প্রদান করা হবে। যা আজ ২৪ এপ্রিল শনিবার সকাল ১১টায় আনুষ্ঠানিকভাবে বাড়িটি রেবেকা’কে হস্তান্তর করা হবে।