বিশ্বনাথের ক্ষণজন্মা বাউল চাঁন মিয়া

বিশ্বনাথের ক্ষণজন্মা বাউল চাঁন মিয়া

জন্মেছি বলেই দেখেছি ধরা,
হেঁসে খেলে ক’দিন,
চলে যাব আবার-
চির সত্য রীতি মেনে
যাব আমি মারা।।

 
আমি থাকবনা এ জগতে চির অমর হয়ে এটা মহা সত্য। যেমন পূর্বের  কতো মহাজন , মহাজ্ঞানী, আবাল বৃদ্ধ-বণিতা কেউই বেঁচে থাকেননি। মৃত্যু কতো কঠিন, তারপরও সবাইকে তার স্বাদ গ্রহন করতেই হয়। মৃত্যুর হাত থেকে পরিত্রাণের কোনো পথ নেই, কোনো অযুহাতের সরঞ্জাম নেই যে তাকে ঠেকানো যাবে, তাড়ানো যাবে। ধরা পড়তেই হবে আজ না হয় কাল। এই নিয়ম চলতেই আছে, চলতেই থাকবে। যাই হোক আমরা আশরাফুল মাখলুকাত মানুষের জীবনকর্ম, ইতিহাস খুঁজি অনেক সময়, এবং তাদের কর্মপরিধি নতুন করে জানতে হয়, জানাতে হয়। মানুষের কর্মগুণ খুঁজতে গেলে জীবদ্দশার ডাইরী মেলানো যায় কার কতটুকু ভারি, কার কতটুকু হালকা। অনেক সময় কোনো কোনো মানুষ দুনিয়ার পথ পাড়ি দেবার পর তার কৃতকর্মের প্রচার প্রসার আলোচনায় আলোচিত, সমালোচিত হয়। তবে সমালোচনার চেয়ে গুণাবলীর আলোচনা করা উত্তম। এবং ভাল কর্মের দিকগুলো আলোচনা করাই ইসলামের দৃষ্টিতে তাগিদ রয়েছে। আমিও বলি, যে-কারো ভাল দিকগুলো আলোচনাই হউক। যাদের কর্মজীবনে ভাল কাজ রয়েছে তাঁরা নিঃসন্দেহে জ্ঞানী ও গুণী বটে। গুণীজনের জীবন কর্মালোচনাই একদিকে যেমন আমাদের গুণী বানায় অন্যদিকে তা থেকে কেউ না কে্উ উপকৃত হয়ে জীবনকে আলোকিত করে। অনেকের জীবনে অনুপ্রেরনা যোগায়। এসকল কাজে গুনীদেরকে অমর করেও রাখা যায়। মানুষের ভালমন্দের প্রতিটি কাজের প্রতিদান জীবদ্দশায় কিংবা মরনোত্তর পেয়ে যায় এটা চিরন্ত্রন সত্য। আমি যদি ভাল কাজ করি তাহলে এর প্রতিদান আল্লাহ আমাকে দেবেন কোন সন্দেহ নেই। 
প্রিয় সুধী, মানুষ মরে ঠিকই কিন্তু অমর হয় তার স্বীয় কর্মে। মহাজ্ঞানী, মহাজনকে খুঁজলে তার কর্মগুণ পাওয়া যায়। ভাল মানুষের কর্মগুণকে বাঁচিয়ে রাখতে আমাদের উদ্যোগী হওয়া এসময়ের দাবী। সমাজ সভ্যতায়, ইতিহাসে, ঐতিহ্যে, সাহিত্যে তাদের স্থান দিয়ে রাখা বর্তমান, ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য সুফল বয়ে আনতে সহজ সুলভ হবে বলা যায়। আজকের এ লেখায় যাকে নিয়ে স্বল্পবিস্তর আলোচনা করার সাহস করেছি তাতে পরিপূর্ণতা পাবে না ঠিকই কিন্তু পরবর্তী বিস্তর আলোচনার জন্য সহায়ক হবে এটা আশা রাখছি। শিরোনামে যেমনটি পড়েছেন তেমনটি আলোচনার মূল বিষয়বস্তুর ধারাবাহিকতা রক্ষা করার চেষ্টা করবো আপ্রাণ। শিরোনামখ্যাত বাউল চাঁন মিয়া ১৯৫০ খ্রিষ্টাদ্ধ থেকে ১৯৮৬ খ্রিষ্টাদ্ধ পর‌্যন্ত গানের জগতে বিখ্যাত ছিলেন। এক কথায় যার সংস্কৃতি অঙ্গনে গানের সব শাখে একচেটিয়া দখলদারিত্ব ছিল। যাকে জননন্দিত সুরকার, গীতিকার, শিল্পী ও কৌশলী বলা চলে। যার জন্ম হয়েছে ১৯২৪ সালে সিলেটের প্রাবাসী অধ্যুষিত বিশ্বনাথ উপজেলার, ০২ নং খাজাঞ্চী ইউনিয়নের জয়নগর (নোয়াপাড়া) গ্রামের এক মুসলিম তালুকদার পরিবারে। তাঁর বাবার নাম আশ্রব আলী তালুকদার ও মায়ের নাম মোছাঃ ছৈফা বিবি। এর আগে তাকে নিয়ে ‘দিপ্তী’ নামক ম্যাগাজিনে ছোট পরিসরে কিছু লিখেছিলাম, তাতে ক্লান্ত থাকতে ভেবে ছিলাম এই মনে করে যে বাউলের জীবন ইতিহাস হয়তো এই পর‌্যন্ত। আজ পুনঃবার লিখতে গিয়ে তাকে নিয়ে জানার আগ্রহ বোধ আমাকে ভাবিয়েছে যে কয়েকটি জীবনী গ্রন্থ রচনা করেও শেষ করা যাবে না তার কর্মগুণ। কারণ: বাউল চাঁন মিয়ার জীবনের ৪০টি বছর তিনি গানের ভুবনে কাটিয়েছেন। একজন মানুষের ৪০ বছরের ইতিহাস কতো দীর্ঘ তা সহজে অনুমেয়। ৪০টি বছরে একজন মানুষের জীবনের কতো চড়াই উৎরাই, উত্থান পতন সংঘটিত হয় তা কি দুয়েক পৃষ্ঠা বা এক দুটি প্রবন্ধে বর্ণনা করে সমাপ্তির রেখাপাত করা সম্ভব হয় ? মোটেই না। তবে পরিতাপের বিষয় হলো আমাদের এই ক্ষণজন্মা গুণীপুরুষকে নিয়ে আঞ্চলিক বা রাষ্ট্রীয় ভাবে কেউই মুখ খোলে দু-চার কথা বলতে, লিখতে চোখে পড়েনা আজও। এতে সু-মনের পরিচয় পাওয়া যায়নি এসমাজের হত পরিসর থেকে। যার কারণে আমাদের সভ্য সমাজ থেকে এই ক্ষণজন্মা সংস্কৃত ব্যক্তিকে প্রায় হারিয়ে ফেলার উপক্রমের ধারপ্রান্তে আজ দাড়িয়েছি। নিজেদের সংস্কৃতিকে আমরা নিজেরাই ধ্বংস করতে কার্পন্য করছি না । কিন্তু কেন ? 
আমি আজ মনের টানে তাকে খুঁজতে গিয়ে যা পেয়েছি তা সংক্ষিপ্ত পরিসরে পরিবেশ করা আরেকটি কার্পন্যতার সামিল কিন্তু দীর্ঘ পরিসর পাঠক বিরক্তির কারণ ও সময়ের অভাববোধে সংক্ষিপ্ত না রেখে পারছি না। আমি তাকে নিজ চুক্ষে দেখেছি, তিনি অনেকবার আমার বাড়িতে এসেছেন। আমার বাবার সাথে খুব ঘনিষ্ট সম্পর্ক ছিল তাঁর। আমার স্পষ্ট মনে আছে যে, তিনি শিকারী ঘুঘু পাখি দিয়ে জংলী ঘুঘু পাখি শিকার করতেন, যে অভ্যাসের ও শখের আরেক সৌখিন ছিলেন আমার বাবাও। এছাড়া জন্মসুত্রে পাশা-পাশী গ্রামের বাসিন্দা হওয়াতে অনেক বার আমার বাবা ও বাউল (চাঁন মিয়া) সাহেব দু-জন একসাথে দু-জনের শিকারী দুটি ঘুঘু পিঞ্জিরায় করে বেরিয়ে যেতেনে শিকারের উদ্দশ্যে। অনেকদিন সন্ধায় বাড়ি ফিরতেন দু-জন। আমার বয়স বাড়ার সাথে সাথে এভাবে আমার জীবনের প্রায় ১২-১৩টি বছর তাকে দেখেছি। এরপর তিনি ২০০৪ সালের ১৭ ডিসেম্বর ইন্তেকাল করেন। তিনির প্রয়াণের পর তাঁর একমাত্র ছেলে বিশিষ্ট লেখক, কবি, সাংবাদিক মিজানুর রহমান মিজান বাবার স্মৃতি রক্ষার্থে বাবার নামানুসারে একটি পাঠাগার প্রতিষ্টা করেন ২০০৬ সালে বিশ্বনাথের স্থানীয় রাজাগঞ্জ বাজারে। যেটি খাজাঞ্চী ইউনিয়নের একটি পূর্ণাঙ্গ পাঠাগার হিসাবে প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে। আমি মাঝে মধ্যে পাঠাগারে সময় কাঠাই। আমার আবার সবসময় পড়ার প্রতি দূর্বলতা আছে। ছোটবেলায় অভাব, অনটন ও প্রতিকুল পরিবেশের কারণে অষ্টমশ্রেণী পর‌্যন্ত পড়ালেখা করে আর পারিনি। অবশেষে ততসময়ের ক্লাসমেট ও আমার দু-চারজন বাল্যবন্ধুর অনুপ্রেরনায় বাংলাদেশ ওপেন ইউনির্ভাসিটির অধীনে এসএসসি ও এইচএসসি, বর্তমানে বিএ (বিএসএস)ডিগ্রির জন্য চেষ্টায় আছি, কিন্তু বয়স বেড়ে গেছে অনেক। মাঝে মধ্যে কলম সচল রাখার চেষ্টা করি। বিগত কয়েকবছর বেশ লেখালেখি করেছি দেশ বিদেশের বিভিন্ন পত্রিকায় ও গণমাধ্যমে। এখন আবার কলমের ধীর গতি বহমান। যাক: চাঁন মিয়া সাহেবের কথা বলছিলাম। চাঁন মিয়া সাহেবের একমাত্র ছেলে মিজানুর রহমান মিজান সাহেবকেও আমি আদর্শ হিসাবে বিবেচিত করি। সময় সুযোগ হলে তার সান্নিদ্ধ্যে চলে আসি পাঠাগারে। পারিপার্শিক কথাবার্তার সাথে চাঁন মিয়ার প্রসঙ্গ কখনো চলে আসে। পাঠাগারের পাশা-পাশী মিজান সাহেবের দোকান কৌঠা রয়েছে। এলাকার কাস্টমারই বেশির ভাগ ক্রেতা। পাঠাগারে বসে যখন বাউল সাহেবের কথা আলোচনা করছিলাম তখন চলে আসেন বাউলের তৎকালীন দলভূক্ত শিশু শিল্পী স্থানীয় গনাইঘর নিবাসী মোঃ ইর্শাদ আলী সাহেব। বাউল সম্বদ্ধে তার দেখা জীবনের উল্লেখযোগ্য ঘটনাগুলো আলোকপাত করে তিনি আমাদের সাথে আলোচনায় অংশগ্রহন করেন। ইর্শাদ আলীর বর্ণনাগুলো শুনে বাউল সম্পর্কে লিখার তাৎক্ষণিক আগ্রহ সংবরণ করতে পারিনি বিধায় আমি তার আলোচনার বিষয়টুকু কাগজে কলমে লিখার আগ্রহ প্রকাশ করলে তিনি তাতে সায় দেন। ‘দিপ্তী’ ম্যাগজিনে  প্রকাশিত আগের লেখাটি হচ্ছে ছোটবেলা থেকে বাউলের মৃত্যুকালীন সংক্ষিপ্ত ঘটনা প্রবাহ। আর এ লেখায়  শিল্পীর গানের জীবনের ব্যপকতা সম্পর্কে বলার চেষ্টা মাত্র। এপর্বে আমি স্বাক্ষাতকার স্বরুপ বিষয়গুলো নিম্মে তুলে ধরলাম। 
প্রশ্নঃ জনাব ইর্শাদ আলী সাহেব, শিল্পী চাঁন মিয়ার সাথে আপনি অনুমান কতটি গানের অনুষ্ঠানে যোগদান করেছেন।
উত্তরঃ যদিও সঠিক সংখ্যা মনে নেই, তার-পরও শতাধিক তো হবে কোনো সন্দেহ নেই।
প্রশ্নঃ আপনি তখন শিল্পীর সাথে কী করতেন ?
উত্তরঃ আমি তখন তিনির দলের শিশু শিল্পী ছিলাম, এবং ঢফকি ও মন্দিরা বাজাতাম।

প্রশ্নঃ তখনকার সময় বাউল চাঁন মিয়া ও তার জনপ্রিয়তা কেমন ছিল? তিনি কোন ধরনের গান বেশি পরিবেশন করতেন।
উত্তরঃ জনপ্রিয়তা বলতে আমি যা দেখেছি তা ভাষায় প্রকাশ করে বলে বুঝাতে পারবনা, কারণ: আমরা যেথায় গিয়েছি সেখানে চাঁনমিয়ার নাম শুনা মাত্র মানুষের ঢল নেমে যেত। হুমড়ি খেয়ে মানুষ শিল্পীকে শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানাতো এবং তিনি তখনকার সময়ের সমপযোগী গান জারি, সারি, পল্লীগীতি বেশি পরিবেশন করতেন।
প্রশ্নঃ ৭০ দশকের আগেতো মানুষের মাঝে সংস্কৃতির উন্নতি বা বর্তমানের আধুনিকতা কম ছিল, সে ক্ষেত্রে গান পরিবেশনের আয়োজনটা কেমন ছিল?
উত্তরঃ তখন মানুষ বিভিন্ন জায়গায় পালাগানের অনুষ্ঠান করতো বেশি এবং স্টেইজ বাঁধতো, তার পর পীর ফকিরের মাজারে বসতো বড় বড় বাউলদের পীর-মুর্শিদি গানের পালাক্রমে গান পরিবেশনের আয়োজন।
প্রশ্নঃ বাউল চাঁন মিয়া তৎকালীন সময় কতজন শিল্পীর সাথে পালা গান করেছেন, আপনার কি কোনো ধারণা আছে ?
উত্তরঃ হ্যা মনে আছে, তবে সবার নাম ঠিকানা এখন আর মনে নেই। তবে দেশের নাম করা কয়েকজন বাউলের নাম গানের আসরের কথা মনে আছে। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে আমাদের ভুলাগঞ্জ গ্রামের আরব শাহ এর মাজার, ছাতক উপজেলার ছনবাড়ি নিবাসী বাউল উদাসী মুজিব এর সাথে। কারী আমির উদ্দিন এর সাথে, সিলেটের সিলাম গ্রামের প্রয়াত বেতার বাউল আং খালিক এর সাথে, ছাতকের বাউল সাবলু মিয়ার সাথে, সিলেট সালুটিকর এর বাউল পাখি মিয়া, বাউল আলী হুসেন, প্রয়াত বেতার বাউল অন্নদা রঞ্জন এর সাথে। এছাড়া বাউল সম্রাট শাহ আব্দুল করিম এর সাথে ও বাউল কফিল উদ্দিন এর সাথে গান করেছেন। বাউল মুজিব সরকার চাঁন মিয়ার বাড়িতে একাধারে তিনমাস অবস্থান করেন গান পরিবেশনের কলাকৌশল রপ্তের অভিপ্রায়ে।
প্রশ্নঃ চাঁন মিয়ার সাথে থাকাকালীন গুরুত্বপূর্ণ কোন কোন পালাগান আসরের নাম, স্থানের নাম আপনার মনে আছে।
উত্তরঃ বিশ্বনাথের ভুলাগঞ্জ গ্রাম, বাওনপুর (কাইমগঞ্জ) গ্রাম, প্রতাপপুর, হালকিয়ারী, ছাতক উপজেলার ছনবাড়ি, জাউয়া বাজার,  বরাটুকা, সিলেট সদর যুগির গাঁও, সিলাম, সালুটিকর, টিলাগড়, বালাগঞ্জ উপজেলার মান্দারুকা, দক্ষিন সুরমা উপজেলার মোগলাবাজার ও রাখাল গঞ্জসহ প্রভৃতি স্থানে।
প্রশ্নঃ এমন একটি আসরের কথা বলুন যেখানে আপনার দেখা সর্বাধিক শ্রোতা উপস্থিত ছিল।
উত্তরঃ সিলেট সদরের যুগির গাঁও গ্রামে। আমরা সেখানে পালাগান করেছিলাম বাউল পাখি মিয়ার সাথে। দর্শক সংখ্যা কয়েক হাজার ছিল সেখানে।
প্রশ্নঃ দেশে এতো বাউল শিল্পী থাকার পর মানুষ চাঁন মিয়াকে এতো পছন্দ করতো কেন।
উত্তরঃ সত্যি কথা হলো তিনির কন্ঠে যে কি যাদু ছিল তা নিয়ে আজও আমি ভাবি। গান পরিবেশনের পাশা-পাশী উপস্থাপনের কলাকৌশলও ছিল মাধুরর‌্য্য মন্ডিত। আবার সুঠাম দেহের উজ্জ্বল চেহারার এক দৃপ্তময় পুরুষ ছিলেন তিনি। এছাড়া হাস্যজ্জল কথাবার্তা যে কেউ বাউলের প্রতি আকৃষ্ট হতেন।
প্রশ্নঃ আপনিতো তাঁর সাথে শিশুশিল্পী হিসাবে ছিলেন, তখন আপনার সাথে কি অন্য কোনো শিশুশিল্পী ছিলেন। 
উত্তরঃ হ্যা ছিলেন। তখনকার সময় যারা বাউল চাঁন মিয়া সাথে ছিলেন, তারা অনেকেই এখনো বেঁচে আছেন। অনেকেই প্রতিষ্টিত গুণী শিল্পী হয়েছেন। দু-একজনের নাম ও মনে আছে। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন ছাতক উপজেলার জামলাবাদ গ্রামের বাউল কালামিয়া, বাউল জালাল উদ্দিন, বিশ্বনাথ উপজেলার বাউল নছি খাঁন, ও পংকি খান বাউল।
প্রশ্নঃ বাউলের তৎসময়ের সঙ্গি-সাথী দু-একজনের নাম বলতে পারবেন।
উত্তরঃ হ্যা বলতে পারব। জীবিত মৃতদের মধ্যে যাদের নাম মনে আছে তারা হলেন, আয়ুব আলী গনাইঘর নিবাসী, ইর্শাদ আলী (আমি নিজে) হামদরচক গ্রামের জহুর আলী, তেরাব আলী, ভুলাগঞ্জ গ্রামের হাসমত উল্লাহ, উম্মর আলী, তেলিকুনা গ্রামের হাশিম উল্লাহ, রইছ আলী, গোবিন্দগঞ্জ গ্রামের মান উল্লাহ বেজ, কাবিলপুর গ্রামের, রতন উল্লাহ বিশেষ।
প্রশ্নঃ বাউল চাঁন মিয়া রচিত কোনো গান আপনার মনে আছে।
উত্তরঃ হ্যা, আজও বেশ কিছু গান আমার মনে আছে। যে গানগুলো মানুষ মুখে-মুখে জপ করতো এবং সমপযোগি ছিল বলে গানগুলো মানুষকে দারুন উপভোগ্যতা দিতো বলে আমার কাছে পরিলক্ষিত হয়েছে। তিনির রচিত ভক্তিমূলক এই গানটি খুব জনপ্রিয় ছিল সে সময়।
(১)     হরিণী কান্দিয়া বলে, পড়িয়াছি শিকারীর জালে
    তরাইয়া লও আমারে নবী মোস্তফায় গো।ঐ
অতপরঃ
কারবালার যুদ্ধের ইতিহাস স্মরণে রচিত আলোচিত গান নিম্মরূপ;
(২)     কান্দে ছকিনা বিবিরে স্বামী লইয়া কোলে
    স্বামী হারা করলা আল্লাহ এই না ভূ-মন্ডলে,
    কান্দে ছকিনা বিবিরে………….। ঐ
(৩)    একদিন নবী গেলেন সংসার ছাড়ি,
কইতে না পারি……………..। ঐ

তিনির সর্বাধিক জনপ্রিয় একটি গান হচ্ছে গরীবের গান যা পরবর্তীতে ক্বারী আমির উদ্দিন সাহেব ঐ গানের অনুকরণে একটি গান রচনা করে নিজে গেয়েছেন।
    জনাব ইর্শাদ আলীর সাথে আলাপকালীন সময়ে আরো তিনজন লোকের উপস্থিতি ঘটে পাঠাগারের আঙ্গিনায়। স্থানীয় হামদরচক গ্রামের শুকুর আলী, আমাদের সাথে আলোচনায় অংশ নিলেন। বললেন বাউল চাঁন মিয়ার সু-সম্পর্ক ছিল তার পিতার সাথে, এবং বাউলকে তিনি খুব পছন্দ করতেন।
উপস্থিত ০২ নং খাজাঞ্চী ইউনিয়নের ০৮ নং ওয়ার্ড আওয়ামীলীগ সভাপতি জনাব ওয়ারিছ আলী তার নিজের করে দুটি কথা বলেন; আমাদের গ্রামে অনেক অনুষ্ঠানে বাউল চাঁন মিয়াকে দেখেছি। আমার বয়স তখন ১৮/১৯ বছর ছিল।
১৯৭১ সালের মুক্তিযোদ্ধা তবলপুর নিবাসী মোঃ আলকাছ আলী তিনি প্রথম স্বাক্ষাতকারীর মন্ত্যেবের সাথে একমত পোষণ করেন। এছাড়া উপরে বর্ণিত ২জন এক বাক্যে গেয়ে উঠেন বাউলের বহুল জনপ্রিয় এই গানটি। “গরীব হইলে ভবে কেউ চিনেনা,
রে গরীব……………..।ঐ
গরীব ধনীর কাছে গেলে মনে মনে বলে,
কোন জিনিষ নিতো আইছে করে ভাবনা।
রে গরীব……………..।ঐ
“গরীব হইলে ভবে কেউ চিনেনা
এই গানটি বাউল চাঁন মিয়া স্বরচিত প্রথম গান। জনাব ইশাদ আলী আরেকটি গানের দু’টি লাইন বলেন এভাবে-
কুহেতুরের পাহাড়েতেরে মুসা পয়গাম্বর
রোজ রোজ আনতেন যাইয়া আরশের খবর
কুহেতুরের পাহাড়েতে-রে।ঐ

প্রিয় পাঠক কলেবর বৃদ্ধির আশংকায় সংক্ষিপ্ত করার চেষ্টা করছি।তাই তিনিকে পরবর্তী প্রশ্ন করলে সম্বস্বরে উপস্থিত চারজনই এক বাক্যে উত্তর দিতে থাকেন। তাই আমি এবার একেক জনকে প্রশ্ন করি। 
প্রশ্ন: ইশাদ আলী সাহেব শিল্পীর সাথে চলার জীবনে কোন স্মরণীয় ঘটনা কি মনে আছে।
উত্তর: হ্যাঁ মনে আছে, এক সময় চাঁন মিয়া সাহেব একটি “বেহালা” লন্ডন থেকে তিনির এক ভক্ত কর্তৃক প্রাপ্ত হন এবং সিলেটের সালুটিকর নামক স্থানে কারী আমির উদ্দিন এর সাথে পালা গানে অংশ নিলে তিনির ‘বেহালা’টির একটি তার ছিড়ে ফেলেন আমির উদ্দিন সাহেব। এছাড়া তিনির নিজের তৈরী “একতারা”, “দুতারা” দিয়ে বাদ্য যন্ত্র বানিয়ে বাজাতেন।
প্রশ্ন: ওয়ারিছ আলী সাহেব বাউলকে আজ এত বছর পর কিভাবে দেখছেন?
উত্তর: আসলে আমরা তিনির সাথে নিমক হারামী’র মত আচরণ করছি। কারন আমাদের উচিত ছিল তিনিকে খুজে খুজে অমর ও অক্ষয় করে রাখা এবং তাঁর স্বরচিত সংস্কৃতির উৎস গানগুলো সংরক্ষণ করে রাখা ও আমাদের সমাজ সভ্যতা থেকে তিনিকে কৃতজ্ঞ চিত্তে স্মরণ করা। আজ তিনির মত একজন গায়ক, সুরকার ও গীতিকার আমাদের খুবই প্রয়োজন।কিন্তু তিনি আজ আর আমাদের মধ্যে বেঁচে নেই।সত্যিই আমি তিনিকে খুব ভাল বাসতাম। আমি আজ ভারাক্রান্ত মনে তাঁর বিদেহী আত্মার শান্তি ও মাগফেরাত কামনা করছি।
প্রশ্ন: জনাব আলকাছ আলী সাহেব আপনি বলুনতো আজ আমাদের চাঁন মিয়া সাহেবকে নিয়ে কি করা দরকার?কি পদক্ষেপ এই ক্ষণজন্মা মানুষটিকে অক্ষয় করে রাখতে পারে?
উত্তর: সত্যি কথা হল গুণীজনকে সম্মান ও শ্রদ্ধা করলে আমাদের মান সম্মান বৃদ্ধি পাবে। তখনকার সময় মানুষ তিনির গান শুনে গানগুলো রেকর্ড করে নিয়ে যেত ক্যাসেটের মাধ্যমে। তখন হয়ত কাগজে কলমে কেউ সংরক্ষিত করেনি মনে হয়। যার কারনে তিনির ৪০/৪২ বছরের সাধনা আজ বিলীনের পথে। তো আমার মনে হয় একটু শ্রম, ত্যাগ ও সময় ব্যয় করা হলে জনাব চাঁন মিয়া সাহেবের স্বরচিত গানগুলো লোক মুখ থেকে সংগ্রহ করে তা সংরক্ষিত করা যাবে এবং বিভিন্ন জনের কাছে রেকর্ডকৃত ক্যাসেটগুলো ও সংরক্ষণ করা যেতে পারে। বাউলের স্মৃতি ধারণার্থে তিনির সুযোগ্য পুত্র মিজানুর রহমান মিজান যে চাঁন মিয়া স্মৃতি পাঠাগার প্রতিষ্টা করে তাঁর স্মৃতি রক্ষার দায়িত্ব গ্রহণ করেছেনতা প্রশংসার দাবীদার। এখানেই বাউলের জীবনীতিহাস ও কুড়িয়ে পাওয়া জিনিষ পত্র সংরক্ষণ করা বা করে রাখা সমকালীন পদক্ষেপ বৈকি আমাদের দায়বদ্ধতার কিছুটা হলে ও শোধ হবে।তার পাশাপাশি আমি আহবান করছি যদি বাউল চাঁন মিয়ার কোন গান বা কোন তথ্যাদি জেনে থাকেন বা জানা আছে এমন কেউ থাকেন আপনি দয়া করে সিলেটের বিশ্বনাথ উপজেলার রাজা গঞ্জ বাজারে চাঁন মিয়া স্মৃতি পাঠাগারে পৌছে দিয়ে সহযোগিতা করবেন।
প্রশ্ন: আপনারা চারজনই কি মনে করেন বর্তমান গানের জগৎ আর আগের গানের জগতে পার্থক্য রয়েছে?
উত্তর: হ্যাঁ।
প্রশ্ন: আপনারা কোন ধরণের গান এখন ও পছন্দ করেন?
উত্তর: আমরা আগের জারি, সারি, ভাটিয়ালী ও পল্লীগান ভালবাসি। কারন তাতে আমাদের পুরনো দিনের সংস্কৃতি, ইতিহাস ও ঐতিহ্যের প্রতিকৃতি রয়েছে।
প্রশ্ন: বর্তমান গান বা বিনোদন ভাল না লাগার কারন কি?
উত্তর: বর্তমান গান’র জগত উদাসিনতায় আক্রান্ত। সময় নেই, শ্রেণী নেই, ইতিহাস নেই, নেই ঐতিহ্য।টুনা-টুনির গান আর ফষ্টি নষ্টির গানে দেশ ভাসমান।
প্রশ্ন: আপনারা কোন ধরণের গান এখন কামনা করেন? 
উত্তর: আমরা চাই দেশের প্রবীণ বাউলরা যে গান দিয়ে দেশের সংস্কৃতিকে জোরদার করেছেন, মানুষকে আনন্দ ও পরিতৃপ্তি দিয়েছেন। ঠিক আগের মত পরিবেশে অতীত স্মরণে আমাদের আধুনিকতায় এগিয়ে যেতে হবে।
   প্রয় পাঠক আমি আর দীর্ঘায়িত করছিনা। অবশেষে শুধু অনুরোধ রইল, আমরা সবাই যেন গুণীজনকে সম্মান ও শ্রদ্ধা করি, তাঁদের ইতিহাস ও কর্ম জীবন অমর করে রাখি। চাঁন মিয়া স্মৃতি পাঠাগার হোক স্মৃতির পসরায় এক সোনালী ইতিহাস।এ কামনান্তে।   
     

মুহাম্মদ শায়েস্থা মিয়া মাসিক জুনাকী সম্পাদক বিশ্বনাথ সিলেট।
    
 

আরও পড়ুন

×