প্রকাশিত: 14/02/2020
সাহিত্য প্রতিনিধি : ‘সোনালি কাবিন’ খ্যাত কালজয়ী কবি আল মাহমুদ লোকান্তরিত হওয়ার বর্ষপূর্তি আজ। সাহিত্যে নিজের অমরতা নিশ্চিত করে তিনি লোকান্তরের পথে যাত্রা করেছেন ২০১৯ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি। বসন্ত-ভালোবাসার আবেশ গায়ে মেখে। বইমেলার নতুন বইয়ের গন্ধ গায়ে মেখে। তিনি আর কখনো আসবেন না লোকালয়ে, অমর একুশে বইমেলায়। আসবেন না সৌম্য দৃষ্টি নিয়ে। আল মাহমুদ প্রাণহীন হলেও নিজ কীর্তির কারণে প্রাণে প্রাণে ছড়িয়ে আছেন। প্রভাতফেরী, আঁধ ফালি চাঁদ, নারী, নিসর্গ, ফুল-পাখি বা খড়ের গম্বুজের আড়ালে হয়তো খুঁজে পাওয়া যাবে তাঁকে। আর খুঁজলেই পাওয়া যাবে তাঁর নতুন পাঁচটি বই।
কবি আল মাহমুদের প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষ্যে তাঁর রচিত মহাকাব্য ‘এ গল্পের শেষ নেই শুরুও ছিল না’ নামের অপ্রকাশিত পান্ডুলিপি প্রকাশ করেছেন, সরলরেখা প্রকাশনা সংস্থা (বইমেলা স্টল নং ৬১৮)। এ ব্যাপারে সংস্থাটির পরিচালক নাজমুস সায়াদাত জানান, আল মাহমুদ নিজেই একজন মহাকাব্যিক কবি। তবে গেলপ্রায় এক শতাব্দী পর নতুন করে মহাকাব্য রচিত হয়েছে, যা বাংলা সাহিত্যে গৌরবজনক ঘটনা। শিল্পী ধ্রুব এষ ও লেখক আজরা পারভীন সাঈদসহ বড় একটা টিম আল মাহমুদের মহাকাব্য 'এ গল্পের শেষ নেই শুরুও ছিল না' প্রকাশের জন্য দীর্ঘদিন ধরে কাজ করে আসছে। আমরা পাঠকদের হাতে এ প্রকাশনা তুলে দিতে পেরে আনন্দিত। এছাড়া, ইতোমধ্যে আল মাহমুদের ‘সহোদরা’ ও ‘রাগিণী’ নামে ক্ষুদ্রায়তনের দুটি নতুন উপন্যাস প্রকাশিত হয়েছে। অন্যদিকে, মুজিববর্ষের বিশেষ প্রকাশনা হিসেবে তাঁর নতুন কাব্যগ্রন্থ ‘ইতিহাস দেখো বাঁক ঘুরে গেছে ফের ইতিহাসে’ এবং ছড়ার বই ‘আমার নামে ডাকছে পাখি’ প্রকাশিত হতে যাচ্ছে। আল মাহমুদের সাহিত্য জীবনের গোধূলি লগ্নের ছায়াসঙ্গী ও সহলেখক হিসেবে এ পাঁচটি বইয়ের গ্রন্থনা ও সম্পাদনা করেছেন লেখক ও সাংবাদিক আবিদ আজম।
এদিকে, আল মাহমুদের জন্মদিন উপলক্ষে ঢাকা, চট্টগ্রাম ও তাঁর জন্মভিটায় পৃথক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। আল মাহমুদ ফাউন্ডেশনের সাধারন সম্পাদক কবি আবিদ আজম জানিয়েছেন, কিংবদন্তি এ কবির জন্মদিন উপলক্ষে রাজধানীর কাটাবনের কবিতা ক্যাফেতে (২৩৪/সি নিউ এলিফ্যান্ট রোড,কাটাবন সিগন্যাল,ঢাকা) শনিবার বিকেল ৫ টায় ‘আল মাহমুদ স্মরণ’ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। এতে কবির পাঠক, ভক্ত ও অনুরাগীরা উপস্থিত থাকবেন। আর একই দিন চট্টগ্রামের থিয়েটার ইন্সটিটিউটে ক্বণন শুদ্ধতম আবৃত্তি অঙ্গণের আয়োজনে অনুষ্ঠিত হবে এক স্মরণানুষ্ঠান। সেখানে অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ডক্টর নূরুল আমিনসহ অন্যান্যরা। অন্যদিকে, কবির জন্মভিটা ব্রাহ্মণবাড়িয়া মৌড়াইলে সকালের দিকে স্মরণানুষ্ঠান ছাড়াও কবির কবরে শ্রদ্ধাঞ্জলী জ্ঞাপন ও ফাতেহা পাঠ করা হবে। এছাড়া, আল মাহমুদ স্মারকগ্রন্থ প্রকাশনা ছাড়াও কবির প্রয়াণবার্ষিকী উপলক্ষে বৃহৎ পরিসরে একটি অনুষ্ঠান আয়োজনের প্রস্তুতি চলছে বলে জানিয়েছেন আবিদ আজম। এদিকে, ভাষা সংগ্রামী ও মুক্তিযোদ্ধা এ কবিকে মরোনোত্তর স্বাধীনতা পুরস্কারি প্রদানে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে উদ্যোগ নেবার দাবী জানিয়েছেন, কবি পরিবার।
১৯৩৬ সালের ১১ জুলাই ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মৌড়াইল গ্রামের মোল্লাবাড়িতে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের আশীর্বাদ হয়ে জন্মগ্রহণ করেন বরেণ্য কবি আল মাহমুদ। পঞ্চাশের দশকে আবির্ভূত সাহিত্যের সব্যসাচী কবি আল মাহমুদ কবিতা ছাড়াও লিখেছেন উপন্যাস, গল্প, প্রবন্ধ, ছড়া, আত্মজীবনী ইত্যাদি। এ যাবৎ তাঁর প্রকাশিত শতাধিক গ্রন্থ নিয়ে প্রকাশনা সংস্থা ঐতিহ্য মোট ১৩ খন্ডে প্রকাশ করেছে ‘আল মাহমুদ রচনাবলি’। ১৯৬৩ সালে প্রকাশিত হয় আল মাহমুদের প্রথম কবিতার বই ‘লোক লোকান্তর। এর তিন বছর পর ১৯৬৬ সালে প্রকাশিত হয় তার আরও দুটি কবিতার বই ‘কালের কলস ও ‘সোনালী কাবিন’। এর মধ্যে ‘সোনালী কাবিন’ তাঁকে নিয়ে যায় অনন্য উচ্চতায়। এ ছাড়া তার ‘মায়াবী পর্দা দুলে ওঠো’, ‘অদৃষ্টবাদীদের রান্নাবান্না’, ‘একচক্ষু হরিণ’, ‘মিথ্যাবাদী রাখাল’ ও ‘বখতিয়ারের ঘোড়া’ ইত্যাদি কাব্যগ্রন্থ উল্লেখযোগ্য।
‘কাবিলের বোন’, ‘উপমহাদেশ’, ‘ডাহুকি’, ‘আগুনের মেয়ে’, ‘চতুরঙ্গ’ ও ‘পোড়ামাটির জোড়া হাঁস’ ইত্যাদি তার উল্লেখযোগ্য উপন্যাস। ‘পানকৌড়ির রক্ত’সহ বেশ কিছু গল্পগ্রন্থও রচনা করেছেন তিনি। এ ছাড়া ‘যেভাবে বেড়ে উঠি’ ও ‘বিচূর্ণ আয়ণায় কবির মুখ’ তার উল্লেখযোগ্য আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের লিফলেটে কবিতা ছাপা হবার কারণে ফেরারী হওয়া আল মাহমুদ একাত্তরের মুক্তিসংগ্রামে মুজিবনগর সরকার স্টাফ হিসেবে কাজ করেছেন, যুক্ত ছিলেন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সঙ্গেও। নিজের প্রত্যক্ষ মুক্তিযুদ্ধের অভিজ্ঞতা রচনা করে গেছেন কালজয়ী দুটি উপন্যাস ‘কাবিলের বোন’ ও ‘উপমহাদেশ’। তৎকালীন দৈনিক গণকন্ঠ পত্রিকার প্রাক্তণ এই সম্পাদক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আন্তরিক সহায়তায় যোগদান করেছিলেন বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমীতে।
সৃজনশীল সাহিত্য রচনার জন্য অসংখ্য জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন আল মাহমুদ। বাংলা একাডেমী পুরস্কার (১৯৬৮), জয়বাংলা পুরস্কার (১৯৭২), হুমায়ূন কবির স্মৃতি পুরস্কার (১৯৭৪), ফিলিপস সাহিত্য পুরস্কার (১৯৮৬), একুশে পদক (১৯৮৭), নাসিরউদ্দীন স্বর্ণপদক (১৯৯০), সমান্তরাল (ভারত) কর্তৃক ভানুসিংহ সম্মাননা পদক-২০০৪ সম্মাননা উল্লেখযোগ্য। নিজের অসামান্য সাহিত্যকীর্তির কারণে আল মাহমুদ জীবনব্যাপী মানুষের হৃদয়ে আর ইতিহাসের শিলালিপিতে যে অমরতা পেয়েছেন, কোন স্বীকৃতিই তার সঙ্গে তুল্য নয়।