ঝিনাইদহের বারোবাজারের প্রাচীন জনপদকে ঘিরে উঠতে পারে পর্যটন কেন্দ্র

ঝিনাইদহের বারোবাজারের  প্রাচীন জনপদকে  ঘিরে উঠতে পারে পর্যটন কেন্দ্র

ঝিনাইদহের কালীগঞ্জ উপজেলার বারোবাজার একটি প্রাচীন জনপদ। এটাকে অনেকে বারো আউলিয়ার শহর বলে থাকেন। ইসলাম প্রচারের জন্য আউলিয়ারা এসেছিলেন এই জনপদে। প্রায় তিন বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে এখানে আছে পুরানো শহর মোহম্মদাবাদ।১৯৯৩ সালে এখানকার মাটি খুড়ে সন্ধান মেলে পনেরটিরও বেশি মসজিদ। এগুলোর মধ্যে বেশিরভাগই প্রাচীন। এসব মসজিদগুলো ৭০০ বছরেরও বেশি পুরানো।শহর মোহাম্মদাবাদের পুরানো ইতিহাস সম্পর্কে জানা যায়, প্রাচীনকালে বারোবাজারের নাম ছিল ছাপাইনগর। এ নগর ছিল হিন্দু আর বৌদ্ধ শাসকদের রাজধানী। বারো আউলিয়া আসার আগে বৈরাট নগরের বাদশা শাহ সিকান্দার তার সংসর ত্যাগী সন্তানদের কর্মকান্ড ছিল এই জনপদে। পরবর্তীতে বারোজন সহচর নিয়ে হযরত খাজা খানজাহান আলী (রঃ) এখানে আসেন। সেখান থেকেই এর নাম হয় বারোবাজার।যুদ্ধ কিংবা মহামারিতে ছাপাইনগর ধ্বংস হয়ে যায়। থেকে যায় প্রাচীন ইতিহাস। বারোবাজারের মসজিদগুলোর সঙ্গে বাগেরহাটের কয়েকটি মসজিদের বেশ মিল খুঁজে পাওয়া যায়।ঝিনাইদহ-যশোর মহাসড়কের পশ্চিম পাশে বারোবাজার। মহাসড়ক ছেড়ে তাহেরপুর সড়ক ধরে পশ্চিম দিকে যেতে রেল লাইন পেরিয়ে হাতের ডানে শুরুতেই পাওয়া যাবে এক গম্বুজ বিশিষ্ট পাঠাগার মসজিদ। বারোবাজারের সবচেয়ে বড় সাতগাছিয়া আদিনা মসজিদ।৩৫ গম্বুজ বিশিষ্ট প্রায় ধ্বংস হয়ে যাওয়া এ মসজিদটির ভেতরে এখনো দেখা যায় ৪৮ টি পিলার। লাল ইটের তৈরি এই মসজিদ আকারে ছোট। দীর্ঘদিন মাটি চাপা পড়ে থাকার পর ২০০৭ সালে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর মসজিদটি সংস্কার করে।জনশ্রুতি আছে সুলতানী আমলে নির্মিত এই মসজিদ কেন্দ্রিক একটি সমৃদ্ধ পাঠাগার ছিল। মসজিদের পাশেই বড় আকারের একটি দীঘি, নাম পিঠেগড়া পুকুর। আবারও তাহেরপুর সড়ক ধরে সামনে এগুতে হবে। দুটি বাঁক ঘুরলেই বিশাল দিঘি, নাম পীর পুকুর। পশ্চিম পাড়ের মাঝ বরাবর বেশ বড় আকৃতির মসজিদ পীর পুকুর মসজিদ। এই মসজিদও ছিল মাটির নিচে।১৯৯৪ সালে খনন করে বের করা হয়েছে। এই মসজিদে ছাদ নেই, শুধু দেয়াল আছে। মসজিদটি লাল ইটের তৈরি। তাহেরপুর সড়ক ধরে সামান্য পশ্চিম দিকে এগুলে হাতের বাঁয়ে একটু ভেতরের দিকে আরেকটি মসজিদের দেখা মিলবে। এর নাম গোড়া মসজিদ। এই মসজিদ চার গম্বুজ বিশিষ্ট।মসজিদের মিহরাব ও দেয়ালে পোড়ামাটির ফুল, লতাপাতা ফলের নকশাসহ নানান কারুকার্য মন্ডিত। বাইরের দেয়ালও লাল ইটে মোড়ানো। ১৯৮৩ সালে এই মসজিদের সন্ধান পায় প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর। এর পূর্ব পাশেও বড় আকৃতির একটি দিঘি আছে।মসজিদটি খননের সময় একটি কবরের সন্ধান মেলে। জনশ্রুতি আছে কবরটি গোড়াই নামে কোন এক দরবেশের। এ থেকেই এর নাম গোড়ার মসজিদ। গোড়ার মসজিদ থেকে আবারও তাহেরপুর সড়কে সামনের দিকে চলতে হবে। সামান্য গেলে সড়কটির উত্তর পাশে আরও একটি মসজিদ।চার গম্বুজ বিশিষ্ট এই মসজিদের নাম শুনলে ভয় লাগাটাই স্বাভাবিক। নাম ‘গলাকাটা মসজিদ’। প্রায় ২১ ফুট লম্বা ও ১৮ ফুট চওড়া এই মসজিদ খনন করা হয় তোলা হয় ১৯৯৪ সালে। ছয় গম্বুজবিশিষ্ট এই মসজিদের পশ্চিম দেয়ালে তিনটি মিহরাব আছে। এর দেয়ালগুলো প্রায় পাঁচ ফুট চওড়া। মাঝখানে আছে লম্বা দুটি কালো পাথর।

১৯৯৪ সালে মসজিদের পাশেই পুরো এলাকা— তথা শহর মোহাম্মদাবাদের প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনগুলোর নির্দেশনা সম্বলিত হাতে আঁকা একটি মানচিত্র। জনশ্রুতি আছে, বারোবাজারে এক অত্যাচারী রাজা ছিল। প্রজাদের বলি দিয়ে ওই দিঘির মধ্যে ফেলে দেওয়া হতো। এ কারণেই এর নাম হয় গলাকাটা। গলাকাটা মসজিদের সামনে শহর মোহাম্মদাবাদের মানচিত্র। বারোবাজারের সবগুলো প্রত্নস্থলের নির্দেশনা আছে এতে।গলাকাটা মসজিদ থেকে সামান্য পশ্চিম পাশে, সড়কের বিপরীত দিকে আরেকটি এক গম্বুজ বিশিষ্ট মসজিদ। নাম জোড় বাংলা। মসজিদটি খনন করা হয় ১৯৯৩ সালে।খননের সময় এখানে একটি ইট পাওয়া যায়, তাতে আরবী অক্ষরে লেখা ছিল, `শাহ সুলতান মাহমুদ ইবনে হুসাইন, আটশো হিজরী`। জনশ্রুতি আছে মসজিদের পাশে জোড়া কুড়েঘর ছিল বলেই এর নাম জোড় বাংলা মসজিদ।এবার পাশের সড়ক ধরে আরও কিছু দূরে এগুলে সাতগাছিয়া আদিনা মসজিদের সাইন বোর্ড চোখে পড়বে। পাকা সড়ক ছেড়ে হাতের ডানে মেঠোপথে সামান্য সামনের দিকে চলতে হবে। এখানেও বড় একটি পুকুরের দক্ষিণ পাশে সাতগাছিয়া আদিনা মসজিদের ধ্বংসাবশেষ।এটির শুধু দেয়াল আর নিচের অংশই অবশিষ্ট আছে। স্থানীয়দের মতে সর্বপ্রথম গ্রামের লোকজনই মাটিচাপা পড়ে থাকা এই মসজিদ উদ্ধার করে। আকারে এ এলাকার সবচেয়ে বড় মসজিদ এটি। প্রায় ৭৭ ফুট লম্বা ও ৫৫ ফুট চওড়া মসজিদের ভেতরে আছে ৪৮টি পিলার। পশ্চিম দেয়ালে লতা-পাতার নকশা সমৃদ্ধ তিনটি মিহরাব আছে।সাতগাছিয়া মসজিদ থেকে এবার চলে আসা যাক পেছনের দিকে। বারোবাজার রেল লাইনের পশ্চিম দিকে বিশাল এক দিঘির পশ্চিম পাড় ধরে একটি সড়ক চলে গেছে হাসিলবাগ গ্রামে। এখানেও একটি বড় দিঘির পশ্চিম পাশে রয়েছে এক গম্বুজ বিশিষ্ট নুনগোলা মসজিদ। বর্গাকৃতির এ মসজিদে তিনটি অর্ধ বৃত্তকার মিহরাব আছে।এ অঞ্চলের সবচেয়ে বড় এক গম্বুজ বিশিষ্ট মসজিদ এটি। স্থানীয়রা একে লবণগোলা মসজিদও বলে থাকেন। তবে এ নামকরণের কোন সুনির্দিষ্ট তথ্য পাওয়া যায় না। নুনগোলা মসজিদের সামান্য পশ্চিমে হাসিলবাগ গ্রামে আরও একটি এক গম্বুজ মসজিদ আছে।হাসিলবাগ মসজিদ নামে পরিচিত এ মসজিদের মূল নাম শুকুর মল্লিক মসজিদ। পোড়া মাটির তৈরি মসজিদটি এ অঞ্চলের সবচেয়ে ছোট এক গম্বুজ বিশিষ্ট মসজিদ। এসব স্থাপনাগুলো ছাড়াও বারোবাজারে আছে আরও কিছু প্রসিদ্ধ স্থান।এসবের মধ্যে উল্লেখযাগ্য হল ঘোপের ঢিবি কবরস্থান, নামাজগাহ কবরস্থান, জাহাজঘাটা, মনোহর মসজিদ, দমদম প্রত্নস্থান, বাদেডিহি কবরস্থান, খড়ের দিঘি কবরস্থান।

আরও পড়ুন

×