প্রকাশিত: 20/02/2020
যতো দিন যাচ্ছে নারী অধিকার কর্মীদের তৎপরতা বাড়ছে বৈ কমছে না। দেশের সর্বোচ্চ নির্বাহীও একজন নারী। তা সত্ত্বেও ধর্ষণের হার কমছে না। তাহলে ভাবতেই হয় যে দেশটা মূলত কোন দিকে যাচ্ছে? অনেকেই ধর্ষণের জন্য নারীর পোষাককে দায়ী করে থাকেন।
কেউ আবার ধর্মীয় অনুশাসন মেনে না চলাকে কারণ হিসেবে চিহ্নিত করেন। কেউ বা অশ্লীলতা ও বেলেল্লাপনার ছড়াছড়িকে ধর্ষণের ফ্যাক্টর বলছেন।
বর্তমানে ধর্ষণ যেই ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে, সেক্ষেত্রে কোনো বিশেষ দিককে আমরা কারণ হিসেবে নির্ধারণ করতে পারি না। মূলত এর জন্য সমাজের সামগ্রিক অধঃপতনই দায়ী। কারণ ধর্ষণের উৎস হলো ধর্ষকের মন।
পত্রিকার পাতা খুললেই ধর্ষণের চিত্র ভেসে ওঠে। এমন একটি দিনও নেই, যেদিনের পত্রিকায় দু'চারটে ধর্ষণের খবর বেরোয় না। এর বাইরেও অনেক ঘটনা আড়ালেই থেকে যায়।
কারণ আমাদের সমাজ ব্যবস্থায় আজ অব্দি ধর্ষণকে নারীদের জন্য অসম্মান ও ব্যক্তিত্বের প্রতি হুমকি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ফলে অভিভাবকগণ এসব ঘটনা চেপে রাখতেই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন।
তারা চায়না বিষয়টি জানাজানি হোক। ইংল্যান্ডের মতো অগ্রসর দেশেও ধর্ষণের ঘটনাগুলির ক্ষেত্রে মাত্র ১৫ শতাংশ ভিক্টিম পুলিশে রিপোর্ট করে।
যুক্তরাজ্যের মিনিস্ট্রি অফ জাস্টিসের একটি সমীক্ষা বলছে তাদের মোট নারী জনসংখ্যার ২০ শতাংশ এবং পুরুষ জনসংখ্যার ৪ শতাংশ ১৬ বছর বয়সের মধ্যেই কোনো না কোনোভাবে যৌন হয়রানির শিকার হন।
২০১৩ সালের একটি রিপোর্ট থেকে জানা যায়, ইংল্যান্ড এবং ওয়েলসে প্রতি ঘন্টায় ১১ টি সিরিয়াস যৌন হয়রানির ঘটনা ঘটে।
স্বাভাবিকভাবেই ধরে নেয়া যায় যে, এই সংখ্যা আগের চাইতে বেড়েছে। তাছাড়া ১৮-২৪ বছর বয়সী মেয়েদের মধ্যে ৩১ শতাংশ অভিযোগ করেছেন যে, তারা তাদের শৈশবেই যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন।
যদিও ধর্ষণের ক্ষেত্রে একজন নারী কোনোভাবেই দোষী নন। কিন্তু এখনও আমাদের সমাজব্যবস্থায় কাঙ্খিত দৃষ্টিভঙ্গি প্রতিষ্ঠা সম্ভব হয়নি।
বর্তমানে বিশ্বজুড়েই ধর্ষণ একটি ভয়াবহ সমস্যা। সাম্প্রতিক বাংলাদেশে ধর্ষণ একটি দুরপনেয় মহামারীতে রূপ নিয়েছে। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (ASK) তথ্যমতে ২০১৯ সালে ১৪১৩ জন নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছেন। তন্মধ্যে ধর্ষণের পর ৭৬ জনের মৃত্যু হয়েছে।
এবং ১০ জন নারী সামাজিক বঞ্চনার কথা ভেবে আত্মহননের পথ বেছে নিতে বাধ্য হয়েছেন। চরম উদ্বেগের বিষয় হলো এগুলোর মধ্যে গ্যাং রেপের ঘটনা ঘটেছে ৩২৭ টি।
যা দেশ ও সমাজের ভয়ংকর অধঃপতনকে নির্দেশ করে। এছাড়াও গত বছর শিশু ধর্ষণের প্রবণতা ছিল মাত্রাতিরিক্ত পর্যায়ের।
বিভিন্ন গণমাধ্যমের তথ্য যাচাই করে ঢাকা ট্রিবিউনের একটি জরিপে বলা হয়েছে গত বছর সাকুল্যে ১৩৮৩ টি শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে। অর্থাৎ গড়ে প্রায় ৪ জন শিশু এই পশুত্বের বলি হয়েছে।
ধর্ষণের এই ভয়াবহ প্রবণতার কারণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে বিশেষজ্ঞরা মোটাদাগে কিছু বিষয় নির্ধারণ করেছেন। তন্মধ্যে যে ব্যাপারে সকলেই একমত হয়েছেন সেটি হলো, ধর্ষণের বিচারিক প্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রতা এবং দলীয় প্রভাব বা অর্থ বল কাজে লাগিয়ে আইনের ফাঁক গলে ধর্ষকদের বেরিয়ে যাওয়া। যে কারণে ধর্ষণের বিভীষিকা ক্রমেই বেড়ে চলেছে।
তাহলে এই ভয়ংকর অপরাধকে প্রতিহত করার উপায় কি? সরকারের উচিত হবে ধর্ষণের বিচারকার্য সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করার জন্য আদালতে বিশেষ ব্রাঞ্চের ব্যবস্থা করা।
যদিও ২০১৮ সালে ধর্ষণের বিচার পরিচালনার জন্য বাংলাদেশের বিভিন্ন উপজেলায় প্রায় ৬৮ টি বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়েছে।
তবে বাস্তবতার দিকে দৃষ্টিপাত করলে বোঝা যায় প্রয়োজনের তুলনায় তা নিতান্তই অপ্রতুল। এদিকটা অবশ্যই সরকারের বিবেচনায় নেয়া উচিত।
এছাড়াও যদি আমরা ঘটনার মূল কারণ অনুসন্ধান করি, সেক্ষেত্রে যে বিষয়টি উঠে আসে তা হলো মূল্যবোধের চরম অবক্ষয়। এ ব্যাপারে কমবেশি সকলেই একমত। বিষয়টি সত্যিই ভাববার।
বাংলাদেশের শিক্ষার হার ক্রমান্বয়ে বাড়লেও আমরা গুণগত দিক থেকে অনেক পিছিয়ে আছি। তদুপরি শিক্ষার্থীরা নৈতিক শিক্ষার পাঠ থেকে সরে গিয়ে অভাবিতভাবে বস্তুবাদী শিক্ষার দিকে ঝুঁকছে।
এজন্য যে শুধু তারাই দায়ী সে কথা বলার উপায় নেই। শ্রেণিকক্ষে শিক্ষকদের এব্যাপারে কথা বলতে হবে। শিক্ষার্থীদের মানবিক গুণে উজ্জীবিত করতে হবে।
যেখানেই অন্যায় সেখানেই আইনানুগ প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ধর্ষণ প্রতিরোধের লক্ষ্যে নিয়মিত সভা সেমিনারের আয়োজন করতে হবে।
যার মূল লক্ষ্য থাকবে শিক্ষার্থীদের সচেতন করে তোলা, তাদের নৈতিক মূল্যবোধকে জাগ্রত করা। এছাড়াও যেহেতু মেয়েরা শারীরিকভাবে পুরুষের চাইতে অপেক্ষাকৃত দুর্বল হয়ে থাকে, সেক্ষেত্রে সরকার যদি নিজস্ব উদ্যোগে স্কুল কলেজগুলোতে মেয়েদের আত্মরক্ষামূলক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে, সেটাও এক্ষেত্রে কার্যকরী ভূমিকা রাখতে পারে।
পাশাপাশি বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ধর্ষণ হ্রাস না পাওয়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ হলো বিচার প্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রতা। তাই বিচারিক কার্যক্রমকে গতিশীল ও সময়োপযোগী করার কোনো বিকল্প নেই।
এক্ষেত্রে সরকার ধর্ষণ বিষয়ক মামলাগুলোর বিচারকার্য পরিচালনার জন্য থানায় থানায় বিশেষ নারী পুলিশ অফিসার নিযুক্তির উদ্যোগ নিতে পারে।
এবং এই মামলাগুলো যদি নারী আইনজীবীদের দ্বারা পরিচালিত হয়, তাহলে আশা করা যায় বিচারকার্য গতিশীল হবে। কিছুদিন আগে আমরা দেখেছি পাকিস্তানের একজন নারী পুলিশ কুলসুম ফাতিমা মাত্র দু'মাসে দুইশটি ধর্ষণ মামলার তদন্ত সম্পন্ন করে আলোচিত হয়েছেন।
সব মিলিয়ে বলা যায়, সচেতনতার পাশাপাশি মানুষের নৈতিক ভিত্তি মজবুতকরণ, সুশিক্ষার হার বৃদ্ধি, ধর্মীয় মূল্যবোধ তৈরি ও মেয়েদেরকে আত্মরক্ষামূলক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করলে ধর্ষণের লাগাম টেনে ধরা সম্ভব হবে।
তবে বাংলাদেশে ধর্ষণের প্রবণতা যে ভয়াল রূপ পরিগ্রহ করেছে, বিচারকার্য গতিশীলকরণ এবং ধর্ষককে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির আওতায় না আনা পর্যন্ত এই অপরাধ বন্ধ হবে বলে মনে হয় না। আমরা ধর্ষণ মুক্ত বাংলাদেশ চাই।