স্বপ্ন-সত্য-বাস্তব

স্বপ্ন-সত্য-বাস্তব

স্বপ্ন-সত্য-বাস্তব

মিজানুর রহমান মিজান 

ডিগ্রি পরিক্ষার রেজাল্ট আউট হয়েছে তিন দিন পূর্বে। জানা থাকা সত্তেও একটা অজানা আশঙ্কা, দ্বিধা ও সংকোচে ফলাফল দেখতে শফিক কলেজে যাচেছ না।

ঘনিষ্ট বন্ধুর অনুরোধে সবার অলক্ষে চুপিসারে ঐদিন রাত্রে কলেজে যাবার পথে সহপাঠি আতাউর যখন বলল, শফিক পাশ করেছ জেনেও কেন আমাকে দেখা দিচছ না ? আতাউর ও শফিক একই সঙ্গে ডিগ্রি পরিক্ষা দিয়েছিল, পাশ ও করেছে।

কিন্তু শফিক এমাত্র যাত্রারম্ভ করেছে বাস্তবতা ও সত্যতা যাচাই করতে, ফলাফল সম্পর্কে। কারন শফিকের মনে একটা দ্বন্ধ । সে পাশ করতে পারবে কি না ? আজ ঘনিষ্ট বন্ধু কয়েছ দু’বার পরিক্ষায় ফেল করে পড়াশুনা ছেডে দিয়ে বেকার জীবন কাটাচেছ।

দরিদ্র পিতামাতার একমাত্র সন্তান হওয়া সত্তেও  অমানসিক পরিশ্রম আর কষ্টের বিনিময়ে দ্বিতীয় বিভাগে এস এস সি পাশ করেই একটি দোকানে চাকুরী গ্রহণ করে।

চাকুরীতে অনভ্যস্থ এবং ভোর ৬ টা থেকে এক নাগাড়ে রাত্রি ১২ টা পর্যন্ত কর্তব্য ও দায়িত্ব পালনে শারিরিক অবস্থা অত্যন্ত কাহিল হয়ে পড়ায় চাকুরীতে ইস্তফা দিতে সিদ্ধান্তে উপনিত হয়।

কারন শফিকের কাজে ফাঁকি দেয়ার বিন্দুমাত্র ইচেছ নেই। বরং অতিরিক্ত কাজ করতে ইচছুক- সদা প্রস্থুত। সুতরাং মালিকপক্ষ শফিকের দায়িত্ববোধ, কর্তব্যে একনিষ্ঠতা ও সততায় মুগ্ধ হয়ে বার বার থাকার অনুরোধ করা সত্তেও তা উপেক্ষা করে একদিন চলে আসে।

প্রাপ্ত বেতনের সামান্য অংশ আট সদস্যের পরিবারে খরচ করে বাকী টাকা দ্বারা কলেজে একাদশ বিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হয়। যদিও সে ছাত্র ছিল মানবিক বিভাগের এস এস সি-তে।

শফিক লেখাপড়ায় অত্যন্ত ভাল ছিল বলে আলাদা একটা সুনামের অধিকারী ছিল। স্কুল সহ এলাকায়। অনেক সহপাঠী চ্যালেঞ্জ করেও দ্বিতীয় স্থানে হঠাতে পারেনি কখনও। প্রত্যেকটা পরিক্ষায় প্রথম থেকে দশম শ্রেণী পর্যন্ত ফাস্টবয় হিসেবে উত্তীর্ণ হয়েছে।

১৯৭৭ সালে শহর ব্যতীত পল্লী অঞ্চলে কোন কলেজ শফিকের এলাকায় ছিল না। তাছাড়া শফিকের বাড়ি থেকে শহরের দুরত্ব ছিল ( ১২ মাইল)- প্রায় ১৮ কিলোমিটার।

শহরের সাথে যোগাযোগের একমাত্র ব্যবস্থা ছিল রেলওয়ে। বাড়ি থেকে ৫ কি.মি পায়ে হেটে ষ্টেশন পর্যন্ত। সেখান থেকে ট্রেনে শহরে পৌছা। কোন দিন ট্রেন ফেল করলে শ্রীচরণের উপর নির্ভর করে অভীষ্ট বা গন্তব্যস্থল কলেজে পৌছতে হত

তবে এখনকার মত নয়টার ট্রেন কয়টায় ছাড়ে এ প্রশ্নের উদ্রেক হত না। যথা নিয়মে নির্দিষ্ট সময় ট্রেন চলাচল ছিল নৈমিত্তিক ব্যাপার। দৈবাত ব্যতিক্রম ছাড়া।

সুতরাং ট্রেন ফেলের ভয়ে সেহরীসম খাবার খেয়ে শহরে পৌছে দশটার তথা ক্লাস আরম্ভ হবার পূর্বক্ষণ পর্যন্ত হোটেল অথবা কলেজের কেন্টিনে বসে সময় কাটাতে হত।

তবে একটা সুন্দর ও আনন্দঘন পরিবেশ ছিল। অত্র এলাকা থেকে তখন কলেজযাত্রী ছাত্র সংখ্যা প্রায় চল্লিশজনের মত ছিল নিয়মিত। শফিক বন্ধুদের সাহচর্যে থেকে ক্লাস করে।

তারপর ও নিয়তির অমোঘ বিধান আর ভাগ্যের সুপ্রসন্নতা বুঝি অদূরে থেকে মিটি মিটি হাসছিল। অর্থনৈতিক দুরাবস্থা এবং পারিবারিক দায়িত্ববোধে সচেতনতার জন্য চাকুরী বা অর্থোপার্জন অতীব জরুরী হয়ে পড়ে।

সমস্যা জর্জরিত জীবনে পড়ালেখায় মনোযোগী কতক্ষণ থাকা সম্ভবপর হয়? চারদিক থেকে অমাবষ্যার আঁধার চাঁদের আলোকে ম্লান করে দেয়- ধীরে ধীরে।

অন্যনুপায় হয়ে একজন উকিলের সহকারী হিসেবে কাজ শুরু করে দিনের বেলা। প্রয়োজন আর বাস্তবতার নিরিখে কলেজের দিবাবিভাগ থেকে নৈশবিভাগে পরিবর্তন আনতে হয়।

তিন মাস বিজ্ঞান বিভাগে পড়ার সুবাদে স্যারদের আশ্বাসবাণী বা আত্ম-বিশ্বাস এসেছিল শফিকের প্রতি। মানবিক বিভাগ থেকে আসলেও বিজ্ঞান বিভাগে সফলতা অর্জনের সম্ভাবনার পরিচয়।

কিন্তু নৈশ বিভাগে বিজ্ঞান বিভাগের সুযোগ ছিল না। তবে সবচেয়ে আশার কথা তখন মদন মোহন কলেজে নৈশবিভাগ ছিল অন্ততপক্ষে শফিকের লেখাপড়া করার একটা পথ ছিল।

নতুবা অকালে ঝরে পডত অত্যন্ত আগ্রহী থাকা সত্তেও। সে সময় বর্তমানের মত এত সুযোগ বা বেসরকারী ব্যবস্থা ও ছিল না। যা হোক শফিক গ্রুপ পরিবর্তন করে বাণিজ্য বিভাগের পুরাতন বইপত্র ক্রয় করে পরিচিত অগ্রজ একজনের নিকট থেকে।

কলেজযাত্রী সহপাঠীদের সহিত আংশিক সাহচর্য আছে শফিকের ভাগ্য লিপির খাতায়। সকালের ট্রেনে প্রতিদিন সবার সহযাত্রী থাকা সম্ভব হল না।

বন্ধুরা কলেজের পাঠ সমাপ্তির পর বিকাল বেলার ট্রেনে বাড়ি অভিমুখে রওয়ানা হয় আর শফিক দিনের বেলা কর্তব্য পালনের পর নৈশ বিভাগে ক্লাস করে রাত্রি দশটার ট্রেনে বাড়ি অভিমুখে যাত্রা করে গৃহে পৌছে আহার বিহার সমাপ্তির পর নিদ্রা দেবীকে জড়িয়ে কতক্ষণ পর সেহরী তুল্য আহার গ্রহণ এবং গোসল, পোষাক পরিচছদ পরিধানের পর প্রাত্যহিক কাজ শুরু করতে সময় কতটুকু থাকে- তা সহজে অনুমেয়।

তথাপি শফিকের জীবন যুদ্ধ থেমে নেই। একজন অকুতোভয় সৈনিক হিসেবে যুদ্ধক্ষেত্রে অগ্রযাত্রীরূপে অগ্রসরমান।বৈচিত্রময় পৃথিবীর বিচিত্ররূপ সর্বক্ষণ ধারণ করে চলছে কালের চাকায় পিষ্টতার নিরিখে।

সমাজ, সামাজিকতা পরিবর্তনশীল অহরহ নিত্য নুতনরূপে। আরো বিচিত্রিতা- বৈচিত্রময় বাংলার শ্যামল সুন্দর প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমন্ডিত প্রান্তরে কত মানুষ কতরূপে যে জীবন যাপন করছে তার হিসাব আমরা বা ক’জন রাখি ? আমরা প্রয়োজন বোধ করি ? তবে জেনে রাখা ভাল সম্ভব হলে এ প্রয়োজনবোধটুকু আপন নিবাস থেকে চাওয়া-পাওয়ারূপে।

এতে লাভ ছাড়া ক্ষতি দেখি না। একাধারে দু’মাস শফিক আইনজীবির সহকারী হিসেবে ব্যয় করে যদিও একটু স্বাচছন্দ বোধ করছিল। কিন্তু তার মনে অজানা একটা শংকা ও সংকোচবোধ ছিল সদা জাগ্রত।

“এখানে নয়, অন্য খানে, অন্য কোথাও ” এ ভাব বা বোধে ছিল মত্ত। সত্যিই এক দিন এ কাজে ইস্তফা দিয়ে ঢুকে পড়ে সাব রেজিষ্টারী অফিসে নকল নবীশ পদে যোগদানের মাধ্যমে।

নকল নবীশ চাকুরী থেকে ইন্টারমিড়িয়েট পরীক্ষ পাশ করে তৃতীয় বিভাগে। শফিক দারুন চিন্তায় পতিত হল । তৃতীয় বিভাগে পাশ করা কাম্য ছিল না।

কিন্তু ভোর বেলা বাড়ি হতে রওয়ানা হয়ে রাত ১২ টা /১ টায় এসে লেখাপড়ার সুয়োগ কতটুকৃ তা আবার একটু তীৰ্ন দৃষ্টি প্রখরতা মেলে দিলে অংক মেলবে।

তথাপি শফিকের জীবন যুদ্ধ থেমে নেই। কারন পৃথিবী ঘূর্ণায়মান আর জীবন চলমান- চলতেই হবে। চলা থামানো সম্ভব নয় এ দুনিয়ার ঘূর্ণিপাকে। এত পরিশ্রম করে শারিরিক, মানসিকভাবে বিপর্যস্থ হয়ে চিন্তার মহাসমুদ্রে সাতার কেটে চলেছে।

কোন কুল কিনারা নেই। চোখের সম্মুখে ভেসে উঠে মা-বাবা-বোনদের করুণ চাহনী। অপর দিকে লেখাপড়ার অত্যন্ত আগ্রহ-ইচছাকে দমন করতে ও বিবেক নামক বস্তু বার বার দায়িত্ববোধ ও কর্তব্য সচেতনতার ঘণ্টা অনবরত চোখের সামনে তুলে ধরে।

তাছাড়া ডিগ্রি ক্লাসে লেখাপড়া করা কতটুকু সহজ বা কঠিন তা শিক্ষিত মাত্রই জ্ঞাত। যাই হোক, অনেক ভাবনা চিন্তার পর ভর্তি হল ঠিকই ফাষ্ট ইয়ারে নাইট বিভাগে।

কিন্তু লেখাপড়ার পরিধি এবং কাজের সম্বন্বয় সাধনে অসামঞ্জস্যতা দেখা দেয়। এক মাস ক্লাস করার পর লেখাপড়া ছেড়ে দেবার সিদ্ধান্তে উপনীত হতে হয় বাধ্য হয়ে চাকুরীকে ধরে রেখে।

এখানে মনে হয় ভাগ্য দেবী সুপ্রসন্ন হয়ে শফিককে আহবান জানান প্রথম থেকে দশম পর্যন্ত পঠিত একটি মাদ্রাসায় শিক্ষক হিসেবে যোগদানের । শফিক বহু চিন্তা ভাবনার পর সিদ্ধান্ত নেয় অন্ততপক্ষে শহরে যাওয়া আসার সময়টুকু বাঁচবে।

অপরপক্ষে মাদ্রাসা বাড়ির নিকটবর্তী এবং শিক্ষকতায় লেখাপড়ার সহায়তা ও অর্থনৈতিক দিক সচল থাকবে। নিজের পক্ষে লেখাপড়ার পথ সুগম হবে। সুতরাং স্কুলে (মাদ্রাসায় ) যোগদান করাই শ্রেয় বিবেচনায় চাকুরী ছেড়ে বাড়িতে আসে।

মাদ্রাসায় শিক্ষক হিসেবে এক বছর অতিক্রান্তে সাধ্যমত লেখাপড়ায় মনোনিবেশ করে। এমনি সময় ডাক আসে শফিকের নিজ অধ্যয়ণকারী হাই স্কুলে যোগদানের নিমিত্তে।

এলাকার আহবানকে স্বাগত জানিয়ে আনন্দচিত্তে যোগদান করে ঐ স্কুলে সহকারী শিক্ষকরুপে। স্কুলে ঐ সময় তারই অপর এক সহপাঠি ও যোগদান করে। সহপাঠির লেখাপড়া নিয়মিত সচল থাকলে ও শফিক অনিয়মিত।

ফাষ্ট ইয়ার থেকে সেকেন্ড ইয়ারে উত্তীর্ণ পরিক্ষা শফিকের দেয়া সম্ভব হয়নি নানাবিধ জটিলতার কারণে। লেখাপড়ার ক্ষেত্রে যবনিকাপাত ঘটেপ্রায় শফিকের জীবনে।

কিন্তু টেষ্ট পরিক্ষার মাত্র এক মাস পূর্বে শফিকের ভাবান্তর ঘটে, দারুণ আগ্রহ ও ঝোঁক চেপে বসে মাথায় এবং অধ্যক্ষের নিকট যোগাযোগ করে তার হৃদয়ের আর্তি অতি যত্ন সহকারে প্রকাশ করে তিনির দোয়াসহ অনুমতি প্রার্থী হয়।

শ্রদ্ধেয় অধ্যক্ষ মহোদয় শফিকের অদম্য স্পৃহা, আগ্রহ , ইচছা , অনুপ্রেরণা, উৎসাহ উদ্দীপনায় মুগ্ধ হয়ে শেষ পর্যন্ত অনিচছার ইচছা প্রকাশ বা মতামত প্রদান করেন। শেষ পর্যন্ত পরিক্ষার ফলাফলে সবাইকে চমকে দিয়ে উত্তীর্ণ হয়।

কিন্তু সহপাঠি (যে নিয়মিত) অবিশ্বাস্য ও অপ্রত্যাশিত ভাবে ফেল করে। কিন্তু আমি নির্ধিদ্বায় ও অত্যন্ত সচেতনতারসহিত বলতে পারি দৃঢ়তার সঙ্গে নকল নামক শব্দটির সঙ্গে শফিক ছিল সম্পুর্ণ অজ্ঞাত ,অখ্যাত।

শফিকের মেধাশক্তিই তার সাফল্যের চাবি কাঠি। কিন্তু লজ্জায় এ সকল প্রতিভা থেকে যায় অজ্ঞাত, লোকচক্ষুর অন্তরালে। এমন অনেক প্রতিভা সুপ্ত বিকশিত হতে পারে না দারিদ্র্যতার কষাঘাতে জর্জরিত থাকার ফলে।

ওরা পারে না নীচে নামতে। আবার উপরে উঠার সিড়ি থাকে নাগালের বাইরে। অপরপক্ষে শফিকের প্রতিভা যেন বিকাশের পথ সহজসাধ্য হয় এ কামনা সর্বা্তেকরণে, সর্বক্ষণ। ” ইচছা থাকলে উপায় হয়” যত বাধাঁ বিপত্তি আসুক না কেন ? জয় হোক স্পৃহা ও বাসনার সর্বকালে।

আরও পড়ুন

×