ধর্ষণের দর্শন ৪

প্রকাশিত: 16/10/2020

শামীম আহমেদ

ধর্ষণের দর্শন ৪

পৃথিবীতে চাইলেই সবকিছু পাওয়া যায়? অনেকে এমনভাবে বড় হয়ে উঠে যে সবসময় সে যা চাইবে তা ই পাবে। তাকে কিছু প্রত্যাখ্যান করা হলে সেটা সে গ্রহণ করতে পারেনা। কিছু শিশু পারিবারিক ভাবেই শৈশবে এভাবে অধৈর্য হয়ে বেরে ওঠে। পরিবার থেকে তাকে নিয়ন্ত্রন করা না হলে, শিশুটি যখন বড় হতে থাকে তখন পর্যায়ক্রমে তার এই উশৃংখল জীবনের নেতিবাচক প্রভাবে আক্রান্ত হয় প্রতিবেশিরা এবং পারা মহাল্লায় বসবাসকারি নারী, সর্বপরি সমাজ যা রাষ্ট্র পর্যন্ত পৌছায়।

এমন হাজার হাজার উশৃংখল যুবক আমাদের সকল মহল্লায় আছে। এদের চিন্তা মননে মনুষত্ব থাকে না। থাকে না আত্মনিয়ন্ত্রন ক্ষমতাও। এদের ভবিষ্যাৎ বলতে কিছু নাই। আজ এখানে বরগুনা জেলার নয়ন বন্ডকে মূখ্য উদাহরন হিসেবে উল্লেখ করা যায়। তার মনের ইচ্ছেটা এমন ছিলো যে, যা চাইবে তা ই পেতে হবে তাকে। একটি শিশু আগুন যেভাবে ছুতে চায়। উশৃংখল যুবকরা মেয়েদের ঠিক ওই ভাবেই ছুয়ে দেয়। অবশেষে সেই আগুনেই জ্বলে পুড়ে ভস্ম হয়ে যায়। একটি মেয়েকে ছুতে গিয়ে নয়ন বন্ড যেভাবে নিঃশেষ হয়ে গেলো।

পৃথিবীতে চাইলেই যে সবকিছু পাওয়া যায় না, এমন উপলব্ধি যে মানুষের থাকে না। তারা কখনই নিজের ইচ্ছে দমন করতে পারে না। শিশুদের বা যুবকদের এই ধরনের উপলব্ধি না থাকার কারণেই নিজের ধ্বংস ডেকে আনে। এমন বৈশিষ্টের শিশুরা কৈশোর বয়সে এসে প্রেমে ব্যর্থ হয়ে সহিংষ্ণু আচরণের পথ বেছে নিচ্ছে কেউ-কেউ। এটা একটা মানসিক রোগ এবং সামাজিক ব্যাধি।

এই ধরনের মানসিক রুগীদের নিকট কোন নারীই নিরাপদ নয়। মূলত নারী-পুরুষের পরস্পরের প্রতি আকর্ষণ একটি স্বাভাবিক জৈবিক-প্রক্রিয়া। কিন্তু এই জৈবিক অনুভূতি মানে এ নয় যে যৌনাকর্ষণ হলেই সেটা নিবৃত্ত করতে হবে। এর জন্য নিয়মানুযায়ী বৈধ পথ অবলম্বন করতে হবে। ধর্ষণ শব্দটি শুধু ধর্ষকের যৌনতা নিবৃত্ত করার একটা প্রক্রিয়া নয়, বরং এ ধরনের আচরণ ধর্ষকের জটিল ও অন্ধকার মনোজগৎকে প্রতিফলিত করে। অধিকাংশ ধর্ষকের মধ্যে হীনম্মন্যতাবোধ, ক্ষমতা দেখানোর প্রবণতা, মমত্ববোধের অভাব, নারীর প্রতি অবমাননাকর মনোভাব কাজ করে। অনেক ক্ষেত্রে এ ধরনের যৌন নিপীড়নকারীরা নানা রকম যৌন অসুস্থতা, পেডোফিলিয়া, স্যাডিজম ইত্যাদি সমস্যায়ও ভুগে থাকে। পেডোফিলিয়া বা শিশুর প্রতি যৌন চাহিদা একটি ব্যাধি হিসাবে বর্ণনা করতে চাই। নিজের কাছের মানুষ কর্তৃক অনেক শিশু ধর্ষনের শিকার হয়। সেই ধর্ষকরাই নারীর প্রতি অসহিষ্ণু হয়ে ওঠে। মানুষরুপি এমন পশুরাই সুযোগসন্ধানী আচরণের চরম প্রকাশ করে। রাস্তায়, গণপরিবহন বা কর্মস্থলে নারীদের শরীরে অনাকাঙ্ক্ষিত স্পর্শ করার চেষ্টাসহ সুযোগসন্ধানী আচরণ করতে দেখা যায়।

ধর্ষকাম যৌনতাকে যৌনবিকৃতির একটি শ্রেণী হিসেবে বর্ণনা করা হয়। এই অবস্থাকে ধর্ষকাম যৌন বৈকল্য হিসেবে উল্লেখ করা হয়। যৌন ধর্ষকাম (Sexual sadism) "যৌনবিকৃতি আচরণে কৃত্রিমভাবে সঙ্গীকে বেধে তার সাথে যৌন আচরণ করা। তীব্র পর্যায়ের যৌনবিকৃতিমুলক আচরণে সঙ্গীর সম্মতিবিনা এমনভাবে যৌনক্রিয়া করা হয়, যা তার জন্য তীব্র বেদনাদায়ক এবং স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। এমন আচার করে সেই শিশুরা, যারা পরিবার থেকে ধর্যহীন অবস্থায় বেরে উঠছে। তারাই নিজের স্ত্রী এবং অন্য নারীর সাথে এভাবে ক্রমাগত এবং ইচ্ছাকৃতভাবে নিজের যৌন উত্তেজনাকে উপভোগ করার জন্য সঙ্গীর সম্মতি না নিয়ে তাকে কষ্ট দিয়ে উত্তেজনা উপভোগ করতে থাকে। অর্থাৎ যে লোক যৌন ক্রিয়া করার সময় উদ্ভটভাবে তার যৌন চাহিদা চরিতার্থ করে সেটাই "যৌনবিকৃতি"।

শিশুরা এই ধরনের যৌন কর্ম শিখে পর্ন সাইট থেকে। এরাই শহরের অলিগলিতে নারীদের অহেতুক বিরক্ত করে। এসব উশৃংখল ছেলেদের মধ্যে একটি অশং যৌন বৈকল্য। চলার পথে নারীদের উত্যক্ত করে, কোনোরুপ যৌন আগ্রহ প্রকাশ করে না এবং নিজের স্ত্রী বা সঙ্গীর সাথে সাথে নিজের প্রতিও সে উদাসীন থাকে। এরুপ ছেলের অতীতে কোনো হিংস্রতা বা অপরাধের ইতিহাস জড়িত থাকে। তবে অনেকে আবার ধর্ষকামী হয়ে উঠে।

ধর্ষণের ঘটনা কমাতে চাইলে প্রথম পদক্ষেপটা নিতে হবে পরিবার থেকে। আমাদের মানসিক গঠন অর্থাৎ অন্যের প্রতি আমাদের আচরণ, মানবিক গুণাবলি, নারীর প্রতি সম্মানবোধ, সম্পর্কের প্রতি দায়বদ্ধতাবোধ, সংবেদনশীলতা ইত্যাদি মূলত তৈরি হয়ে যায় শৈশব ও কৈশোরেই। এমনকি যৌনতা সম্পর্কে আমাদের প্রাথমিক ধারণাও তৈরি হয় এ বয়সেই। সুতরাং বিষয়টার প্রতি সম্মানবোধ, এর সঙ্গে সম্পর্কিত অন্যের প্রতি দায়িত্ববোধ, নিজের আগ্রহ বা আবেগের প্রতি সীমারেখা টানা ইত্যাদিও তৈরি হতে পারে। সুতরাং কৈশোরে পা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই সন্তানদের প্রকৃত সেক্স এডুকেশন, সম্পর্কের সীমারেখা সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা দেওয়া ইত্যাদি একজন কিশোরকে ব্যক্তি হিসেবে গড়ে ওঠার প্রক্রিয়ায় ইতিবাচক প্রভাব রাখতে পারে। এর বাইরে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে পরিবারের মধ্যে নারীর প্রতি সম্মানবোধের চর্চা। এ ক্ষেত্রে পরিবারের পুরুষেরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে। যে পরিবারে নারীদের মতামত যথেষ্ট মূল্যায়িত হয়, নারী-পুরুষের পারস্পরিক সম্মান দেখে যে কিশোরটি বড় হয়, তার মধ্যে যৌন নিপীড়নের মতো নেতিবাচক বৈশিষ্ট্য থাকার সম্ভাবনা কম থাকে।

এ ছাড়াও ছেলেবেলা থেকেই ছেলেমেয়েদের মধ্যে খেলাধুলার সুযোগ, মা-বাবার সঙ্গে সন্তানের বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক, ইতিবাচক বৈশিষ্ট্যের প্রশংসা করলে আত্মবিশ্বাসী ও মানবিক হতে সাহায্য করে। মেয়ে বা ছেলেসন্তানকে ছোটবেলা থেকেই ভালো ও খারাপ স্পর্শ সম্পর্কে ধারণা দেওয়া, অপরিচিত ব্যক্তির কাছে একা না ছাড়া ইত্যাদির বিষয়ও মা-বাবার মনোযোগী হওয়া দরকার। তবে শিশুদের যৌন হয়রানি বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই পরিচিত ব্যক্তি বা পরিবারের কাছের মানুষের মাধ্যমে হয়ে থাকে। তাই ব্যক্তি যে-ই হোক, সে স্পর্শ অস্বস্তিকারক বা ভালো নয় বলে মনে হবে, সেটা মা-বাবাকে জানাতে হবে। এ কথাও মনে রাখা দরকার, মেয়েশিশুদের নিরাপত্তার নামে যদি তার বাইরে খেলাধুলা, অন্যদের সঙ্গে মেলামেশা ইত্যাদি করতে না দেওয়া হয়, তবে তার সামাজিক দক্ষতা কম হবে, ফলে প্রকৃতপক্ষে আরও অরক্ষিত হবে।

মেয়েদের জীবনে ধর্ষণ এমন একটি নেতিবাচক অভিজ্ঞতা, যার জের বইতে হয় সারা জীবন। এটি শুধু একজন মেয়েকে শারীরিক কষ্ট দেয় না, এটির মাধ্যমে তার মনোজগতে ভীষণ ক্ষত তৈরি হয়। তার আত্মবিশ্বাস, নিজের নেতিবাচক ধারণা, পুরুষের প্রতি নেতিবাচক ধারণা, সম্পর্কে অবিশ্বাসসহ সবকিছুই হতে পারে।

শহরের অলিগলিতে মেয়েরা যেভাবে ধর্ষনের শিকার হয় তার একটি বাস্তব কেস স্টাডি এখানে তুলে ধরছি।

ঢাকার সনিআখড়া এলাকার পাটেরবাগ মাইনকা চিপার গলিতে আমি একটি অসহয় মেয়ের সঙ্গী হয়েছিলাম। ধর্ষকদের হাত থেকে সুরক্ষা দিতেই মেয়েটির জন্য আমার সাহায্যের হাত সম্প্রসারিত করেছিলাম। স্থানটি পাটেরবাগ কেন্দ্রীয় জামে মসজিদের পূর্ব পাশের। একাদিক গলি বা ছোট সংযোগ সড়ক আছে। মসজিদ থেকে পূর্বের দিকে গলিটিতে প্রবেশ করে সামনে আরোএকটু হেটে গেলে, এক গলি থেকে অন্যগলির একটি সংযোগ গলি পাওয়া যায়। সংকুচিত পথ বা চিপা গলি সেটা। সেই গলিটির দেয়ালে লেখা আছে "মাইনকা চিপার গলি পাটেরভাগ"। দেয়ালের এই লিখন কাদের হাতের? এখন বুঝতেই পারছেন বিকৃত মানুষিকতার বহিঃপ্রকাশ। এই চিপা গলির মুখে রাত দিনের অধিকাংশ সময় কিছু উঠতি বয়সি ছেলের উপস্থিতি লক্ষ করা যায়। ছেলেগুলো আমি চিনি না। এসব ছেলেরা বখাটে নাকি আদর্শবান তা নিয়ে আমার মন্তব্য নেই। কারন লেখার গোড়ার দিকেই এই পর্যারের ছেলেদের নিয়ে বলছি।

১৬ আগষ্ট ২০১৯। রাত তখন ৮টার কাছাকাছি। আমি মসজিদটির মেইন গেটের সড়ক থেকে একটি বাড়িতে যাওয়ার উদ্দেশ্যে গলিতে প্রবেশের মুহুর্তেই সেখানে দাড়িয়ে থাকা একটি মেয়ে আমার নজরে আসে। মেয়েটি আমাকে দেখেই ভীত কন্ঠে বলে উঠলো "ভাইয়া আপনি এই গলিতেই যাচ্ছেনতো আপনার সাথে সাথে আমি যেতে চাই"। আমি কিছুটা বিব্রত হয়ে থমকে দাড়িয়ে জানতে চাই তা কেন যাবেন? কোথায় যাবেন? আপনি রাস্তা চেনেন না? মেয়েটি উত্তর দিয়ে বলছে "চিনি ভাইয়া‌, আমার বাসা এই গলির শেষ মাথায়। তবে সন্ধ্যার পর গলিতে কিছু ছেলেরা থাকে তারা আমাকে প্রায়সময়ই খুব ডিষ্টার্ব করে"। আমাদের এই কথোপকথন মাত্র এক মিনিটেই শেষ হয়। মুহুর্তে আমি সম্মতি দিয়ে মেয়েটিকে বলছি তুমি আমার সাথে এসো শুরু করি পথ চলা। গলির কিছু দুর হেটে যাওয়ার পর কিছু ছেলেদের দেখতে পেয়েছি। বয়স সম্ভবত ১৫ থেকে ১৭ বছর। শুরুতে ওর দিকে আমি একবার তাকিয়েছি। সড়কে তেমন লাইট নেই। দুরের কিছু লাইটে সরকটিতে অল্প অল্প আলো। স্পষ্ট আলো না থাকায় ভালো করে ওদের মুখ দেখিনি। আমি অনেক বেশি ব্যস্ত ছিলাম। একটি বাড়িতে যাওয়ার জন্য ওই গলিতে প্রবেশ করেছিলাম। মেয়েটিকে নিরাপদে পৌছে দিতে আমাকে হাটতে হয়েছে তার গন্তব্য পর্যন্ত। আমার সেই নির্দিষ্ট বাসায় না গিয়ে মেয়েটিকে পৌছে দেয়ার দ্বায়িত্ব নিয়েছিলাম। এবং অনুধাবন করছি আমার নিজের বোন হলে সেই বোন কিভাবে এই পরিস্থিতি মোকাবেলা করতো?

অসহয় এমন একটি মানুষের সহযোগিতার কথা চিন্তা করে নিজের দ্বায়িত্ববোধ থেকেই মেয়েটিকে তার বাসার কাছা কাছি পৌছে দেয়ার জন্য পথ চলার অভিজ্ঞতা আমার মনে আছে। চলার পথে আমি ওর দিকে তাকাইনি। তবে দুজনে চলতে চলতে কিছু কথা হয়েছে। তার মুখে শুনেছি, গলিতে থাকা ছেলেরা মেয়েটিকে একা পেলেই বিরক্ত করে, বাজে কথা বলে। এমন দু'একটি কথা সে বলতে বলতে পথ হাটছে। আমি কেবল শুনছি। মেয়েটি বলছে সঙ্গবদ্ধ ৭/৮ জন উঠতি বয়সি ছেলেরা এই গলিতে প্রায় সময়ই আড্ডা দেয়। ওদের অধিকাংশের বয়স মেয়েটির থেকে দুই বা তিন বছরের বেশি। মেয়েটি আমার সাথে এমন ভাবে পথ অতিক্রম করছে যেন সে আমার সঙ্গী। অর্থাৎ মেয়েটি ওই ছেলেদের নিকট প্রমান করতে চাইছে সে একা নয়। মেয়েটিকে সাথে নিয়ে যখন ওই ছেলেদের অবস্থানের জায়গা অতিক্রম করে কিছু দুর এগিয়েছি তখন মেয়েটি ধন্যবাদ দিয়ে আমায় বিদায় দিতে চাইলেও আমি তাকে আরো নিরাপদ দুরত্বে পৌছে দেই। অর্থাৎ তার বাসার কাছাকাছি। এর পরই মেয়েটি আমায় ধন্যবাদ দিয়ে বিদায় দেয়। আমাকে বলছে- "ভাইয়া আপনি আমার জন্য এতোদূর আসছেন তাই আপনার জন্য দোয়া করবো"। ধন্যবাদ শব্দটি তার মুখে বেশ কয়েকবার উচ্চরিত হতে শুনছি।

বখাটে ছেলেগুলো দেখেই বরগুনার সেই নয়ন বন্ড বা ০০৭ গ্রুপের কথা মনে আসছে। ছেলেগুলো মেয়েটির দিকে দৃষ্টি দিয়েছিলো। শির উচ্চ করে আমি মেয়েটিকে সাথে নিয়ে যেমন করে হেটে যাচ্ছিলাম তাতে ছেলে গুলো মুখে কোন শব্দ করেনি। আমার মনে পড়ছিলো তখন রবি ঠাকুরের কথা "পুরুষেরাই নারীর বল" ।

নিজের একটি কাজ নিয়ে বেশি চিন্তিত থাকায় মেয়েটির দিকে আমি তাকাইনি, কেবল চলতে চলতে পাশ থেকে তার কথাই শুনছি। আমার সেই ব্যস্ততার মধ্যেও মেয়েটিকে সাহায্য করতে পারায় নিজের দ্বায়িত্ব পালন করার মতোই ভালো লাগছিলো। এমন ভালো কাজ করার সুযোগ মানুষের খুব কমই আসে। আমি‌ মেয়েটিকে চিনিনা এবং সেই বখাটে ছেলেদেরও চিনিনা। কেবল সড়কটি চিনি। দু চার মিনিট পর যখন আমি একই‌ গলি দিয়ে পেছনে ফিরে আসি তখন দেখলাম ছেলেদের সঙ্গবদ্ধ সেই দলটি ছত্রবঙ্গ হয়ে যায়।

আমি ভেবে দেখছি এই মেয়েটির মতো কতো মেয়ে ঢাকার শহরের গলিতে নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। সড়কটি সিটি কর্পোরেশনের আওতাধীন হলেও ওই‌ অঞ্চল সিটি কর্পোরেশনের সকল সুবিদা থেকে বঞ্চিত। মেয়েটিকে আমি একদিন সাহায্য করছি। জানি না তাকে প্রতিদিন কে সাহায্য করবে। আমার ভরসা আছে বড় সাহায্য কারির প্রতি। এমন সকল অসহায় মেয়েদের সাহায্যের জন্য আল্লাহ তো আছেই‌ ।

সেদিন রাত সারে দশটার সময় প্রধানমন্ত্রীর কার্যলয়ের একজন বিশেষ ও গুরুত্বপুর্ন কর্মকর্তা হুমায়ুন ভাই আমার একটি প্রয়োজনিয় কাজ করে দিয়েছিলেন। মেয়েটিকে ওই সাহায্যটুকো করে দেয়ার পর আমার একটি সফলতা আল্লাহ দিয়েছেন। এমনটা ভেবে প্রধানমন্ত্রীর কার্যলয় থেকে ফিরে এসেছি তখন রাত ১১ টা। আমার মনে আছে, সেই রাতে পাটেরবাগ কেন্দ্রীয় জামে মসজিদে পৌছে দু রাকাত শোকরানা নামাজ পড়েছিলাম।

নারীর ক্ষমতায়নে কথা এখন মুখে মুখে উচ্চরিত হয়। দু' এক শতাংশ নারী ক্ষমতাধর হলেও প্রায় সকলেই ঘরে বাইরে এখনও অসহয়। এমনকি ক্ষমতাধর নারীরাও নিজের স্বামী কর্তৃক নির্যাতনের স্বীকার। অনেক ক্ষমতাধর নারীর সাথে আমার ব্যক্তিগত আলাপ হয়েছে। সেই অভিজ্ঞতা ভিত্তিতে রবি ঠাকুরের লিখছেন- বল দাও জননী আমারে। থেকে থেকে ওই শুনি রাজগৃহ হতে “ফিরে এস, ফিরে এস বাণী” প্রেমপুর্ণ পুরাতন সেই কণ্ঠস্বর। খড়গ নিয়ে তুমি এসো, দাড়াও রুধিয়া পথ। বল, “তুমি যাও, রাজধৰ্ম্ম উঠুকু জাগিয়া, ধন্ত হোক রাজা, প্রজা হোক স্বর্থী, রাজ্যে ফিরে আস্থক কল্যাণ। দূর হোক যত অত্যাচার, ভূপতির যশোরশ্মি হতে ঘুচে যাক কলঙ্ককালিম। তুমি নারী ধরাপ্রাস্তে যেথা স্থান পাও, একাকিনী বসে’ বসে’ নিজ দুঃখে মর বুক ফেটে! পিতৃসত্য পালনের তরে রামচন্দ্র গিয়াছেন বনে, পতিসত্য পালনের লাগি আমি যাব। যে সত্যে অাছেন বাধা মহারাজ রাজ্যলক্ষ্মী কাছে- কভু তাহা সামান্ত নারীর তবে ব্যর্থ হইবে না৷

বাংলাদেশ সরকারকে নারীর অগ্রগতির দিকটায় বেশি নজর দিতে হবে। নারীর ক্ষমতায়নে বাংলাদেশ বিশ্বে উদাহরন তৈরি করলেও বাস্তবতার নিরিখে এর সাদৃশ্য কম। কেননা সার্বিক সুশাসন শুধু নারীর অগ্রগতিকে ত্বরান্বিত করবে না, উন্নয়নের জন্যও এটি অপরিহার্য। উশৃংখল ছেলেদের হাত থেকে রক্ষার জন্য মা বাবা অনেক সময় কম বয়সেই মেয়েকে বিয়ে দিয়ে দেয়। এই বিয়েই তো স্থায়ি সমাধান না। ঢাকায় নামকরা একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যায়নরত আমার পরিচিত এক ছোট বোনের সাথে আলাপ করে যে ধারনা হয়েছে। তার মন্তব্য এখানে তুলে ধরছি:- (কোট)

"আমার ইচ্ছা ছিল আমি পড়াশোনা কমপ্লিট করবো তারপর চাকরি করবো। কিন্তু আমার পরিবারের চাপে আমাকে বিয়ে করতে হয়।"

"বিয়ের পর দেখছি, চাকরি করার স্বাধীনতা তো নেইই বরং সন্তান নেয়ার জন্য স্বামী এবং শ্বশুর বাড়ীর লোকের কাছ থেকে এক ধরণের চাপের মধ্যে থাকি।"

"সন্তান নেয়ার বিষয়টি একটা মেয়ের একান্ত ব্যক্তিগত বিষয়। কখন সে মানসিক এবং শারীরিকভাবে প্রস্তুত সেটা সেই মেয়েই বলতে পারে। কিন্তু আমার ক্ষেত্রে সেটা হয়নি। শুধু আমার ক্ষেত্রে না, আমি দেখি আমার মত আরো মেয়েদের একই অবস্থা।"

(আনকোট) যাদের হয়ত পড়াশোনা শেষ করে নিজের একটা কিছু করার তীব্র ইচ্ছা আছে। কিন্তু অনেকেরই পরিবারের চাপে নিজের সেই আকাঙ্খাকে শেষ করে দিতে হয়। উপরন্তু যোগ হয় পরিবারে, অন্যদের নতুন নতুন চাহিদা মেনে নেওয়ার জন্য নিজের সাথে নিজের যুদ্ধ। নারী কখনও কখনও একটি পরিবারের নিয়ন্ত্রক হয়।

বিশ্বব্যাংক সম্প্রতি একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে, যেখানে নারী বৈষম্যের মাপকাঠিতে বাংলাদেশের সার্বিক স্কোর এসেছে ৪৯ দশমিক ৩৮ শতাংশ, যা খুবই নিচের দিকে। এতে আটটি সুচকে দেখানো হয়েছে বাংলাদেশের মেয়েদের পরিস্থিতি। সেখানে যেমন রয়েছে সম্পত্তির অধিকার, বিয়ে করা, বা সন্তান নেয়ার মত বিষয়, তেমন রয়েছে যে কোন প্রতিষ্ঠানে চাকরি লাভের সুযোগের মত দিকগুলো।

'নারী, ব্যবসা ও আইন ২০১৯ শীর্ষক' এই প্রতিবেদনটি তৈরির জন্য বিশ্বব্যাংক গত ১০ বছর ধরে বিশ্বের ১৮৭ টি দেশে পর্যবেক্ষণ চালিয়েছে। সেখানে দেখা যাচ্ছে বাংলাদেশে ২০১২ সাল থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত একই স্কোর - ৪৯ দশমিক ৩৮ শতাংশ অর্থাৎ অবস্থার উন্নতি হয়নি। যদিও শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশের বর্তমান সরকার অন্তত ১০ বছর ধরে নারীদের উন্নয়নের বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে। তাহলে কেন এই পরিস্থিতি?

তবে গত বছর ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের (ডব্লিউইএফ) সর্বশেষ বৈশ্বিক লিঙ্গবৈষম্য প্রতিবেদনে নারী-পুরুষের সমতার দিক দিয়ে দক্ষিণ এশিয়ায় সব দেশের ওপরে স্থান পায় বাংলাদেশ। খ্যাতনামা ভারতীয় অর্থনীতিবিদ জঁ দ্রেজ তাঁর ঝোলাওয়ালা অর্থনীতি ও কাণ্ডজ্ঞান বইয়ে বাংলাদেশ-বন্দনায় বলেছেন, ‘সর্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ভারতের থেকে এগিয়ে গেছে। এ ছাড়া বাংলাদেশ প্রাথমিক শিক্ষায় লিঙ্গবৈষম্য দূর করতে সক্ষম হয়েছে। লিঙ্গবৈষম্যের অন্যান্য সূচকে বাংলাদেশের অবস্থা ভারতের চেয়ে ভালো। এমনকি কর্মক্ষেত্রে নারীদের অংশগ্রহণও বাংলাদেশের বেশি। লন্ডন স্কুল অব ইকনোমিকসের সাবেক এই শিক্ষক জঁ দ্রেজ ভারতের তুলনায় যেসব সূচকে বাংলাদেশের এগিয়ে যাওয়ার উদাহরণ দিয়েছেন তার বেশির ভাগই নারীকেন্দ্রিক বা নারীদের সক্রিয় অংশগ্রহণের ফলেই তা অর্জন করা সম্ভব হয়েছে।

নারীর কর্মসংস্থানের বিষয়ে দক্ষিণ এশিয়ায় এগিয়ে থাকা দেশগুলোর অন্যতম বাংলাদেশ। এটি একটি ইতিবাচক দিক। তবে, নারীর কর্মক্ষেত্র যৌন সহিষ্ণু এবং আরো নিরাপদ তৈরি হওয়া দরকার। পুরুষকে নমনীয় ও বানবিক আচারনের মাধ্যেমে নারীকে কর্মক্ষেত্রে উৎসাহিত করা যায়। শেখ হাসিনা সরকার গত এক দশকে পুরুষ ও নারীর মধ্যে মজুরিবৈষম্যও কমিয়ে এনেছে উল্লেখযোগ্য হারে। বিশ্বব্যাংকের ‘ভয়েসেস টু চয়েসেস: বাংলাদেশেস জার্নি ইন উইমেনস ইকোনমিক এমপাওয়ারমেন্ট’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশ যদি এ ধারা অব্যাহত রাখতে পারে তবে লিঙ্গসমতা আরও বাড়বে।

সব ক্ষেত্রে নারীকে নানা ভাবে যৌনতার ইঙ্গিত দেয় কিছু পুরুষ। সহকর্মীর এমন যৌনবিকৃতিমুলক আচরণে অনেক নারী কর্মক্ষত্র থেকে সরে যায়। আর তারই প্রভাব পরে একটি রাষ্ট্রের জাতীয় উন্নয়নে। মানুষরুপি এমন পশুদের সুযোগসন্ধানী আচরণের কারনেই রাস্তায়, গণপরিবহন বা কর্মস্থলে নারীদের খিটখিটে মেজাজে দেখা যায়। নারীর এই খিটখিটে মেজাজ একটা স্বাভাবিক সংসারে প্রভাব ফেলতে পারে। কর্মক্ষেত্রের এই আচারন সংসারে যেকোন কাজের ক্ষেত্রে নারীর বিরক্তির প্রকাশ হতে পারে বা কোনো অন্তর্নিহিত রোগের ফলে হতে পারে। এটা নারীর মানসিক যন্ত্রনা। এই যন্ত্রনার কারন সেই ছেলেটি যে কিনা পারিবারিক ভাবে বেরে উঠছে অধৈর্য ও উশৃংখল ভাবে।

শামীম আহমেদ

লেখক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক

আরও পড়ুন

×