প্রকাশিত: 19/10/2019
দগ্ধ গ্রাম
জসীম উদ্দীন
এইখানে ছিল কালো গ্রাম খানি ,আম কাঠাঁলের ছায়া,
টানিয়া আনিত শীতল বাতাস কত যেন করি মায়া ।
তাহারই তলায় ঘরগুলি ভরে মমতা মুরতি হয়ে ,
ছিল যে তাহারা ভাই বোন আর বউ ছেলেমেয়ে লয়ে ।
সুখের স্বপন জড়ায়ে ঘুরায়েছিল যে তাদের বেড়ে ,
আকাশ হইতে আসিত আশিস দেবর ভবন ছেড়ে ।
গঞ্জের হটে সওদা বেচিত বউ যে কহিত কানে ,
আমার জন্য নয়ান জুড়ির শাড়ি যেন কিনে আনে ।
হাটের ফিরতি পিতারে বেড়িয়া ছোট ছোট ছেলেমেয়ে ,
হাসিত নাচিত বিস্কুট আর চিনির পুতুল পেয়ে ।
গাজির গানের বসিত আসর, গায়েনের সুর দরি ,
যুগ যুগান্তর পার হয়ে কত আসিত কাহিনী পরী ।
কিসে কী হইল , পশ্চিম হতে নরঘাতকেরা আসি ,
সারা গাঁও ভরি আগুন জ্বালায়ে হাসিল অট্টহাসি ।
মার কোল হতে শিশুরে কাড়িয়া কাটিল যে খানখান,
পিতার সামনে মেয়েরে কাটিয়া করিল রক্তস্নান ।
কে কাহার তরে কাঁদিবে কোথায় ; যূপকাষ্ঠের গায় ,
শত সহস্র পড়িল মানুষ ভীষণ খড়গ ধায় ।
শত শিখা মেলি অগ্নিদাহন চাহি আকাশের পানে ,
হয়তো-বা এর ফরয়াদ করি ঊর্ধ্বে নিশ্বাস হানে ।
আকাশের আজিকে নাহি কোনো পাখি , সুনীল আরোসি তার
দিগন্তে মেলি এ ভীষণ রুপ দগ্ধি হে অনিবার ।
মুহূর্তে সব শেষ হয়ে গেল ভস্মবিশেষ গ্রাম ,
দাঁড়ায়ে রয়েছে বিষাদ- মলিন দগ্ধ দুটি আধপোড়া খাম ।
ওই খানে ছিল কুলের গাছটি , স্থলিত দগ্ধ-শাখ,
পাড়ার যত-না ছেলেমেয়েদের নীরবে পড়িছে ডাক ।
আর তো দাহারা ফিরে আসিবে না , নাড়িয়া তাহার ডাল,
পাড়িবে না ফল দস্যু ছেলেরা অবহেলি মার গাল।
সিঁদুরে আমের গাছ ছিল হোথা, বছরের শেস সনে,
শাখা ভরা আম সিঁদুর পরিয়া সাজিত বিয়ের কনে ।
সে গাছে তো আর ধরিবে না আম বৈশাখ মাসের ঝড়ে;
সে ছেলেমেয়েরা আসিবে না পুনঃ আম কুড়াবার তরে ।
সারা গাঁওখানি দগ্ধ শ্মমান , দমকা হাওয়ায় ঘায়,
দীর্ঘ নিস্বাস আকাশে পাতালে ভস্মে উড়িয়া যায় ।